আমাদের অগ্রনায়কঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত চৌধুরী

যুদ্ধ থেকে ফেরা এক শিল্পী মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত চৌধুরী – যুদ্ধোত্তর কালে বাংলাদেশের সমাজকে সাংবাদিকতার মাধ্যমে আধুনিক করতে আরেক যুদ্ধ সম্পন্ন করেছিলেন । আমরা ছিলাম তাঁর সহযোগী। আমাদের সকল ‘প্রাক্তন বিচিত্রা’ সহকর্মীর হয়ে আমার এই অর্ঘ্য। আমরা যেন কোনদিন তাঁর দীক্ষা থেকে না ফিরি।
পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয় ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। প্রয়াত শাহাদত চৌধুরী ছিলেন সেই মেদিনী কাঁপানো মুক্তিযুদ্ধের এক অন্যতম বীর, সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক কিংবদন্তী সম্পাদক।
মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত চৌধুরী ১৯৪৩ সালের ২৮ জুলাই জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন শিল্পী কিন্তু দেশের প্রয়োজনে তুলি রেখে হাতে নিয়েছিলেন আগ্নেয়াস্ত্র। কিন্তু যুদ্ধজয়ের পর সদ্যজাত বাংলাদেশের জন্য করেছিলেন আরেকটি অত্যাবশ্যকীয় এবং অনন্য এক যুদ্ধ। সে ছিল দেশের মানুষের মনন , সৃজন, রুচিশীলতা, মুক্তবুদ্ধি ও অপরিমেয় সম্ভাবনার দিকনির্দেশনা দানকারী এক কৌশলী কলম যুদ্ধ। অস্ত্রের নাম ছিল সাপ্তাহিক বিচিত্রা নামের একটি ম্যাগাজিন। পরে আনন্দ বিচিত্রা ও সাপ্তাহিক ২০০০। আর সহযোদ্ধারা ছিলেন তাঁর প্রশিক্ষিত একদল তরুন সাংবাদিক।
তীক্ষ্ম মেধাবী এই সম্পাদককে পেয়ে ১৯৭২ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত বিচিত্রা বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কারিক, রাজনৈতিক ও শ্বৈল্পিক জগতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে যে পরিবর্তন আনতে পেরেছিল তার তুলনা হবে না কোনদিন। তিনি তিনি ছিলেন একজন পোস্ট মর্ডান চিন্তুক, গ্রগতির এক অনন্য উদ্ভাবক, অভিনব ও বিচিত্র ধ্যান ধারণার প্রবর্তক। তিনি ছিলেন তাঁর নিজস্ব সাংবাদিক বাহিনীর কাজ ও সুখ দঃখের নিত্যসাথী ও সেক্টর কমান্ডার। সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকার এক বিচিত্র প্রাণ ভ্রমরা।
নতুন ধ্যান-ধারণা ও ভাবনা-চিন্তা করাটা অনন্য না। অনন্য হল তার সনাক্তিকরণ ও বাস্তবায়নের জন্য সুযোগ্য বাহক, কর্মী ও ধারকদের অনুসন্ধান করে এনে সে কাজে ব্যপ্ত করে নিরন্তর অনুপ্রেরণা জুগিয়ে তার বা তাদের পাশে থাকা এবং ছোট ছোট জয়ের পর আরো ছোট ছোট গোলপোস্ট নির্মান করে চরম অভিষ্ঠের পথে দেশকে এগিয়ে নেয়া। আজকের এ সমাজের উল্লেখযোগ্য বহু লেখক, সাংস্কৃতিক নেতা, শিল্পী, রাজনীতিক, সাংবাদিক, অর্থনীতিবীদ, ব্যবসায়ী তাঁরই সঙ্গ সাহায্য ও অনুপ্রেরণায় ঋদ্ধ হয়ে সৃষ্টিশীল কাজে সাথী হয়েছেন। কেউ কেউ সূঁচ থেকে ফাল হয়েছেন শুধুমাত্র তাঁরই বুদ্ধি পরামর্শ ও অসাধারণ নেতৃত্বের কারণে। ছড়িয়ে আছেন দেশে বিদেশে।
তাঁর ব্যাপক সাফল্যের সহস্র দিকের একটি ছিল বাংলাদেশের পোশাক ও ফ্যাশন। বলা যায় বাংলাদেশের লাইভ স্টাইল। দেশীয় পোশাকের বিশাল সম্ভারের প্রতি মানুষের চোখ খুলে দেয়া এবং তার বিস্তারের জন্য এর অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ হিসেবে ফ্যাশন জার্নালিজম, দেশী নির্মান কৌশল উত্তরণ, পোশাক মডেলিং, প্রতিযোগীতা, ডিজাইনার প্রবর্তন ও বিপনণ, বাজার সৃষ্টি সহ সবকিছুরই তিনিই ছিলেন প্রধান পৃষ্ঠপোষক। এমনকি এসব ব্যাপারে অন্যান্য পত্র পত্রিকার জন্যও বিচিত্রাই হয়ে উঠেছিল একমাত্র গাইড। আজ বাংলাদেশের মানুষ উল্লিখিত কাজটির জন্য প্রবল শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করে আমাকেও।
এবার নিজের কথাই বলি। নমিত স্বরে বলি, “শাহাদত চৌধুরীর বিচিত্রা” না হলে এই আমি আজ আমিই হতাম না। সাংবাদিকতার দ্বারা বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক রুচি ও আধুনিকী করনে যদি কনামাত্র সংযোজন করে থাকি সে তাঁরই কারণে। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় বাহাত্তরেই। তখন আমি সদ্য প্রতিষ্ঠিত নাট্যদল পারাপার এ আলী ইমামের সঙ্গে যৌথ সম্পাদকত। আমাদের সভাপতি কবীর আনোয়ার। আমি আমাদের লিটল ম্যাগাজিন বিক্রি করছিলাম একুশের বই মেলায় বাংলা একাডেমীতে। এর সম্পাদক ছিলো মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আর বাবলী হক।সেদিন বাংলা একাডেমীর লাল বারান্দায় কবীর ভাই, আমি, কাজল বন্দ্যোপাধায়, সুস্মিতা সবাই ঝোলা নিয়ে আমাদের ‘পারাপার’ লিটল মযাগাজিন বিক্রি করার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছি। এসময় কবীর ভাই আমাকে পিলারের আড়ালে নিয়ে অন্তিম দূরে এক এলোমেলো চুল, পুরু কাচের ভারী ফ্রেমের চশমা পরা ও তুমুল হাস্যকুন্ডের ব্যক্তিকে দেখিয়ে বললেন, ঐ উনিই শাহাদত চৌধুরী। দেখি তার হাতে একখানা ধরাতে পারো কিনা! হ্যাঁ তা পেরেছিলাম। আর পরে তিনিই আমার হাতে ধরে দিয়েছিলেন অনন্য এক দায়বোধের চেতনা।
সাগরময় ঘোষের হিরের নাকছাবি পড়তে পড়তে বিচিত্রায় থাকতেই আমার শা চৌকে মনে হয়েছে তিনিও বাংলাদেশে অনুরূপ কাজ করে চলেছেন। স্তরে স্তরে স্তবকে স্তবকে তরুনদের সুদৃঢ় করে হিরের না হলেও বাংলাদেশের জন্য কিছু সোনার নাকছাবি তৈরি করেছেন । যেমন সাগরময় ঘোষ সুনীল, শীর্ষেন্দু্‌, সমরেশ, তারাপদ আবুল বাসার… সবাইকে দিয়ে লিখিয়ে লিখিয়ে একসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে বাংলা সাহিত্যমান তৈরি করেছেন। তাদের এবং সাহিত্যের বাজার সৃষ্টি করেছেন। লেখকদের ও একটা অবস্থানে নিয়ে গেছেন। শাচৌই সনাক্ত করেছিলেন সাংবাদিকতায় আমার শক্তিটা কোথায় দাঁড়াতে পারে। তাঁর কারনেই অনেকে অলেখক থেকে লেখক, পরিচিত সমাজ কর্মী থেকে সমাজ নির্দেশক, এক্ট্রা থেকে নায়ক নায়িকা, পাতি লেখক থেকে প্রধাণ লেখক, চুনো রাজনীতিক থেকে বরেন্য রাজ নায়ক হয়েছেন।
আমি বিচিত্রায় আমার কালে (১৯৭৮-১৯৮৯) অনেককের সঙ্গে কাজ করেছি তবে আমি প্রবেশ করার বছর দুয়েকের মধ্যে মূল চালিকা শক্তি হয়ে যাদের সংগে যুদ্ধে নামি তার সবাই ছিল প্রায় আমার প্রায় সমবয়সী। আনু মুহাম্মদ , কাজী জাওয়াদ, চন্দন সরকার, আলমগীর রহমান, শাহরিয়ার কবীর, চিন্ময় মুৎ’সুদ্দি। বয়সে একটু বড় ছিলেন মোহাম্মদ মাজফুজ উল্লাহ আর ছোট ছিলেন মঈনুল আহসান সাবের, আসিফ নজরুল, মাহমুদ শফিক, কবিতা, মিজানুর রহমান খান, সেলিম ওমরাও।। এছাড়া ছিলেন ইরাজ আহমেদ, তারেক শামসুর রহমান, নীনা ইব্রাহিম (হাসেল),রেজওয়ান সিদ্দিকী, হায়দার কিরণ সহ এক ঝাঁক নিয়মিত তরুন ফ্রি ল্যান্সার। এ্যাসাইনমেন্ট ছাড়া অন্য সময় সাপ্তাহিক বিচিত্রা অফিসকে মনে হত যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুদা’র ক্যান্টিন- এমনই আড্ডা, তর্ক, তান্ডব চলতো।
আবার শাহাদত ভাইর কক্ষের আড্ডা ও তর্ক বিতর্কে গিয়ে যোগ দিয়েছি সিরিয়াস হয়ে। নোট নিয়েছি তাঁর বন্ধু বা তাঁর বয়সী আহ্‌মেদ নূরে আলম, আসাদুজ্জামান নূর, ড জাফরুল্লাহ, নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, আলম বা শহীদুল্লাহ খান বাদল এদের কথা থেকে। এক সময় এরা আমারও বন্ধু হয়ে গেছেন। তাঁর টেবিলে নিউজ প্রিন্ট ছিঁড়তে ছিঁড়তে আলাপ করিয়ে দিয়েছেন সামসুদ্দিন আবুল কালাম, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, মহা জাতক, সালেহ চৌধুরী, ফয়েজ আহমেদ, নির্মল সেন, হুমায়ুন আহমেদ ও গাজী শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে।
সব ছাপিয়ে আজ মনে পড়ছে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের কথা। শাচৌ, শাহরিয়ার তাঁকে আম্মা ডাকতেন। আমি শহীদ জননী ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য আমেরিকা গেলে তাঁর টিভি কলাম আর মুনতাসির মামুনের সঙ্গে ‘এখানে সেখানে’ বিভাগ দিয়ে আমার নিয়মিত লেখা শুরু করি । সেই থেকেই দেশে ফিরে তিনি আমারও পরমাত্মীয় হয়েছিলেন।
আমি শুধু বাইরের রিপোর্টিং নয় টিম প্লেয়ার ও হয়েছি তাঁরই কারনে। পেস্টিং ও মেকাপের দিনে সিলোফেন কেটে কেটে আলী ভাইর সঙ্গে মনিরের সঙ্গে সুন্দর আলীর আনা লাল লেবু চা খেয়ে ঘেমে নেয়ে আঠা দিয়ে দিয়ে করেছি নিজের পেজ মেকাপ। সুজিত বসাক ও আবু মাসুমের সঙ্গে বসেছি প্রুফ নিয়ে । হাবীবের সঙ্গে ফ্যাশন বাজেট ও বিজ্ঞাপন। মাথা গরম হয়ে গেলে বা শাচৌর তিরষ্কারে মন মাঠা হলে তিন তলার ব্যালকনীতে মনিরের লাউ গাছের কাছে দাঁড়িয়ে ভেজা চোখ গোপনে মুছেছি। পর মুহূর্তে হয়তো মাসুক হেলাল হাতের কাজ রেখে সুন্দর আলীকে টকটকে লাল লেবু চা আনাতে বলে পাশে এসে বসেছে। কোন কোন দিন কভার ডিজাইনের জন্য তরতর সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেছি শিল্পী লুতফুল হক বা অলোকেশ ঘোষের কাছে। কখনো চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলতে বা নিছক আড্ডার জন্য নেমে গেছি আনন্দ বিচিত্রায়।সেখানে অনুপম হায়াত, মাহমুদা চৌধুরী ও অরুন চৌধুরী সহ কি আড্ডা ! ফটো সুন্দরী থেকে রোজিনার শুটিং অবধি কিছু বাকি থাকতো না।
আমরা বাংলাদেশ একটি আধুনিক দেশ হবার নিমিত্তে যা যা প্রয়োজন তার এক একটি দিক নিয়ে কভার স্টোরি করে করে বা আমাদের দ্বারা করিয়ে শা চৌ আমাদেরকেও সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক এক অবস্থানে নিয়ে গেছিলেন। তাঁর সহধর্মিনী সেলিনা চৌধুরী ও আমি একসঙ্গে কাজ করে বন্ধু হয়ে গেছি। আমাদের বাচ্চারা ঈশিতা সজিব সাশা এষা সহ আর সব সহকর্মীর ছেলেমেয়েরাই ছিলো আমাদের দেশের ফ্যাশন জগতের প্রথম শিশু কিশোর মডেল। তাঁর ভাই মুক্তিযোদ্ধা ড মোরশেদ ও ফতেহ চৌধুরী ও টোকাইর জন্মদাতা রনবী- বন্ধু রফিকুন্নবী রনবী হয়ে উঠেছিলেন আমার ও আজাদেরও বন্ধু।
তখন আমাদের এই একঝাঁক তরুন নিয়েই তাঁর নির্মান কাজ আমি দেখেছি। আমাদের নিয়েই তিনি চলতেন। এদিকে আমাদের প্রত্যেকেরই ছিল অবাধ স্বাধীনতা। তার কারনে আমাদের নিজেদেরও সুযোগ থাকলে ও আমরা গড়ে উঠেছি নিবেদিত আরেক বাহিনী হিসেবে। আবার আমার সূত্রেই অনেক তরুন তরুনী কাজ করতেন। অনুজ সম আরিফ রহমান শিবলী থেকে শুরু করে জসিম মল্লিক, এমদাদ হক, করভি মিজান, ফারিয়া হোসেন, মুনাওয়ার হোসেইন পিয়াল, সাবেরী মোস্তফা, রিফাত আজিম, ইস্তাম্বুল হক, লিয়াকত আলী খোকন, খুরশিদ জাহান, বিজলী হক এবং আরো কয়েকজন। এদের মধ্যে কেউ কেউ ছাত্র, কেউ গৃহিনী,কে উকেউ সংস্কৃতি কর্মী ছিলেন। শিবলী, এমদাদ ও পিয়াল আমার সরাসরি ছাত্র ছিল। জসিম ছাত্র ছিলনা। এবং সেই ছিল একমাত্র ঢাকার বাইরে বরিশাল থেকে রিক্রুট। কেউ কেউ আমার প্রধান সহযোগিদের হাত দিয়েই প্রবেশ করেছিলো- তারা এমদাদ বা শিবলীর বন্ধু বা বোন ছিলো। দেশান্তরী হবার পর এদের সকলের নানান অর্জন আমাকে আপ্লুত করেছে।তাই শাহাদত ভাই আমার নামই দিয়েছিলেন ‘এ্যান্ট্রি পয়েন্ট’।।।
আজ আমার বিলেত বসবাসেরও হয়ে গেল তিন দশক। এখানে ব্রিটিশ বাংলাদেশী পোয়েট্রি কালেক্টিভ, লন্ডন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ স্মারক বিজয়ফুল কর্মসূচী, ডায়াস্পরা সেক্সপীয়র নামের সংগঠনগুলোর প্রতিষ্ঠা করে আমি যে তরুন প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করেছি এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের হাতেই নেতৃত্ব তুলে দিয়ে এসেছি- আমি আমি করিনি। লন্ডন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের চেয়ার আমারই ছাত্র জাকির, বিজয়ফুলের মিলটন, বিবিপিসির ঈশিতা …..এ শিক্ষাও আমি শাচৌ’র কাছ থেকে পেয়েছি।
আমার দেশ বাংলাদেশে ১৯৭৮ সালে সাংবাদিকতার জগতে শাচৌ ছিলেন আমার এ্যন্ট্রি পয়েন্ট। তার কারনেই খুলে গিয়েছিলো আমার অন্তরের চোখ। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত আর তার লাইফ স্টাইল। আসলে শাহাদত ভাই যেভাবে আমাদের তৈরি করেছেন – আমরা সেভাবেই জীবনবীক্ষণ করতে শিখেছি। আজ তাঁর প্রয়ান দিবস।
শা চৌ আমরা তোমাকে অনেক ভালবাসি আর আমরা তোমাকে ভুলবোনা।।
আকবর হায়দার কিরন, নিউইয়র্ক