জীবনের খাতাটা একবার বন্ধ হয়ে গেলে তা আর খোলে না। কিন্তু, জীবন যাপনের খাতা? জীবন যতদিন আছে, ততদিন সেটা বন্ধ করে, আবার নতুন করে খোলা যায়। বদল করা যায় কর্মক্ষেত্র, মাস বা বছরের যাপিত জীবনের হিসেব নিকেশ করে, নতুন হিসেবে চলা যায়। আর যারা ব্যাবসা করেন? হোক তা তেতুলিয়ার ছোট্ট মুদি দোকান, হোক মেঘনা ব্রিজের নিচে রুটি আর মাংসের দোকান কিংবা শহরের আধুনিক বিপনি বিতান। তাদের তো হিসেব নিকেশের খাতা থাকতেই হবে। বছর শেষে আয় ব্যয়ের যোগফল কোষে, সেই খাতা বন্ধ করে খুলত হবে নতুন বছরের খাতা। চৈত্রের শেষ দিন, আর বৈশাখের প্রথম দিন পুরানো খাতা বন্ধ করে, নতুন খাতা খোলার এই নিয়মটাই এখন হালখাতা। কিন্তু, কবে শুরু হয়েছে এই নিয়ম? ৫৯৮ সালে জন্ম নেয়া জ্যোতির্বিজ্ঞানী ব্রহ্মগুপ্ত সূর্যের অবস্থান নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তার নাম ছিলো ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত। এর অনেক পরে খলিফা আল মনসুর এটি তার রাজকীয় ভাষায় অনুবাদ করার আদেশ দেন। এর নাম দেয়া হয়েছিলো ‘সিন্দহিন্দ’। এতে আকাশে অন্যান্য নক্ষত্রের সঙ্গে সূর্যের অবস্থান বিবেচনায় বারোটি ভাগে ভাগ করা ছিলো। এই ভাগের নাম ছিলো রাশি। মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ আর মীন। এই বারোটি রাশি মিলিয়ে বলা হয়েছে রাশিচক্র। বছর নয়। আর সূর্যের অবস্থান এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশের সময়টিকে অর্থাৎ রাশির শেষ দিনটিকে বলা হতো সংক্রান্তি। বছর নয়। মোট বারোটি সংক্রন্তির দেখা মেলে ওই গ্রন্থে। ইসলামি শাসন আমল থেকেই ভারতে হিজরী সাল প্রচলিত ছিলো। এটি চন্দ্রবর্ষ। সূর্যবর্ষ থেকে ১০ বা ১১ দিন কম। বঙ্গ, আসাম, বিহার, উড়িষ্যা অঞ্চল কৃষি নির্ভর। এই এলাকার ফসল উৎপাদন হয় বছরের নির্দিষ্ট সময়ে। হিজরী সাল অনুসারে যে সময়ে খাজনা আদায়ের কথা, সেই সময়টা ১০/১১ দিন পিছিয়ে যেতে যেতে এমন সময়ে চলে যেত, যখন এই অঞ্চলের মানুষ খাজনা দিতে সক্ষম নন। কারণ অনুসন্ধান করে বিষয়টি উপলব্ধি করলেন মোগল সম্রাট আকবর। এই অবস্থা নিরসনে সম্রাট আকবর ইরানের জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনলেন। রাজকার্য পরিচালনার জন্য তাঁকে হিজরী চন্দ্রবর্ষকে সূর্যবর্ষে রুপান্তর করার দায়িত্ব দিলেন। বেশ ক’বছর গবেষণা করে আমির ফতুল্লাহ সিরাজী ১৫৮৪ খৃষ্টাব্দে (হিজরী ৯৯২) নতুন সূর্যবর্ষের রূপরেখা প্রনয়ণ করলেন। তবে সম্রাট আকবর এই নতুন বছর গননা শুরু করলেন এর ২৯ বছর আগে, তাঁর সিংহাসনে আরোহনের মাস থেকে। তিনি সম্রাট হয়ে সিংহাসনে বসেছিলেন ৯৬৩ হিজরীতে। সেই বছর থেকেই গননা শুরু হলো নতুন সূর্যবর্ষ। যার প্রথম মাস বৈশাখ, শেষ মাস চৈত্র। ৯৬৩’র আগে এই সালের কোন হিসেব নেই। তখনকার সেই সালই আজকের বঙ্গাব্দ। ফসলের সময় অনুযায়ী সুবিধাজনক হওয়ায় খুব দ্রুত এই সাল জনপ্রিয় হয়ে গেলো গোটা পূর্ব এশিয়ায়। কারণ এই অঞ্চলের প্রায় সব দেশই কৃষিনির্ভর। রাশিচক্র অনুসারে বিরাজমান বারোটি সংক্রান্তি একিভুত হলো, একটি দিনে। বছরের অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিন। যার নাম চৈত্র সংক্রান্তি।
চৈত্র সংক্রান্তি কেবল বাংলাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। পুরো ভারতেই এই বিশেষ দিনটি পালিত হয়। পাঞ্জাবে এই উৎসবের নাম বৈশাখী, কেরলে বিসু, তামিলনাড়ুতে পুতান্ডু, এ রকম একেক অঞ্চলে একেক নাম। এই বাংলাদেশেই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের রয়েছে নানান রকম নাম যেমন সাংরাই, বিজু, বিসাবী এমন। পার্বত্য অঞ্চলে উৎসব শুরু হয় চৈত্রের শেষ দিন। অনুষ্ঠান চলে তিন দিন ধরে। ভারত উপমহাদেশের বাইরে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড হয়ে ভিয়েতনাম তক এই উৎসব নানা নামে পালিত হয়। আয়োজন বা অনুষ্ঠানের রং যেমনই হোক, মুল বিষয়টি হলো, চৈত্র সংক্রান্তির দিন অর্থাৎ বছরের শেষ দিন, যাবতীয় হিসেব শেষ করে পর দিন পহেলা বৈশাখ নতুন বছরের হিসাবের খাতা খোলা। এটা শুরু হয়েছিলো সম্রাট আকবরের আমলেই। খাজনা দেবার শেষ সময় ছিলো চৈত্র মাসের শেষ দিন। পহেলা বৈশাখ হতো অনুষ্ঠান। এটা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন রাজ্যে। ভূস্বামী কিংবা জমিদারের আঙিনা হয়ে সাধারণ ব্যাবসায়ী পর্যন্ত। কিছু কিছু জায়গায় খাজনা দিতে না পারায়, বড়শীতে গেঁথে চরকে করে ঘোরাত জমিদার কিংবা ভূস্বামীরা। বলা হয়ে থাকে এমন অমানবিক নির্যাতনের বিষয়টি ১৮৯০ সাল পর্যন্ত প্রচলিত ছিলো। এটা এখন চড়ক মেলার একটা অংশ হয়ে গেছে। এর সংগে কিছু পৌরানিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। চৈত্র মাসের পূন্য লগ্নে, শিব ও কালীর মিলন হয় বলে সনাতন ধর্মের মানুষ বিশ্বাস করেন। এ জন্য বৃহত্তর আঙ্গিকে পুজোর আয়োজন করা হয়। দোল বা হোলিউৎসবের উৎপত্তি এই বিশ্বাস থেকেই। এই উপলক্ষে হয় চড়ক পুজা। সন্তান প্রাপ্তি, দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি, মনের বাসনা পূরণের উদ্দেশ্যে পুজা করা হয়। আয়োজিত হয় মেলা। রাজশাহী, খুলনা, রংপুর বিভাগের বিভিন্ন স্থানের পাশাপাশি টাংগাইল, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ এলাকায়ও চড়ক পুজার আয়োজন হয়ে থাকে। বড়ই বর্নিল হয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংরাই, বিসাবী বা বিজু উৎসব। চৈত্রের শেষ দিন শুরু হওয়া এই উৎসবে, তরুণ তরুণীরা নদী বা জলাশয় থেকে পানি এনে বাড়ির বয়স্কদের স্নান করায়। আশীর্বাদ নেয়। এটাকে তারা পূন্যের কাজ মনে করে। প্রতিটি বাড়িতেই নানা স্বাদের খাবার তৈরি করা হয়। সদ্য বিবাহিত বর কনেরা বেড়াতে যায় বাপের বাড়ি। আর যারা বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠেছে, তারা মেতে ওঠে জল উৎসবে। এর প্রচলন কেবল বাংলাদেশেই নয়, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, চীন, কোরিয়া এমন কি জাপানেও রয়েছে। পার্বত্য এলাকায় বাড়িঘর মেরামত করা হয়। শুরু হয় জুম চাষের প্রস্তুতি। নাচে, গানে নানা উৎসবে মেতে ওঠে আমাদের দূর্গম পাহাড়ি এলাকা। পাহাড়ের চেয়ে সমতলেও চৈত্র সংক্রান্তি ঘিরে উৎসব আয়োজন কম নয়। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে হয় নানান রকম মেলা, প্রবর্তনা, শরবত উৎসব, শস্য উৎসব। খেজুর ভাংগা মেলার সংগে জড়িয়ে আছে সন্ন্যাস ব্রত পালনকারীদের বিশেষ প্রার্থনা রীতি। খেতুর মেলা পরিচিত বৈষ্টমী মেলা নামে। রয়েছে টাংগাইলর শাকান্ন উৎসব। এর সংগে জড়িয়ে আছে কৃষক আন্দোলনের স্মৃতি। রয়েছে নীল উৎসব, নীল পুজা বা নীলষষ্ঠী। রয়েছে গম্ভীরা পুজা, সুলতান মেলা। একেক এলাকায় একেক নামের মেলা। এসব মেলায় বাঁশ, বেত, কাঠ, মাটি কিংবা ধাতব তৈজসপত্র, নিত্য ব্যাবহারের পন্য, নানান রকম মিস্টির দোকানের পাশাপাশি, কবিগান, সার্কাস, যাত্রা পালা, পুতুল নাচ এমনসব মজার মজার আয়োজন থাকতো। এর অনেক কিছুই এখন কমে গেছে। তবে মুল আয়োজন এখনও রয়েছে আগের মতই।
মুজতবা সউদ