আনোয়ার হোসেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ‘মুকুট হীন নবাব’ হিসেবে উল্লেখিত হন তিনি। দীর্ঘ একটা সময় জুড়ে এ দেশের চলচ্চিত্র নির্মাতারা তাঁকে ছাড়া ছবি বানাবার কথা ভাবতে দ্বিধা করতেন। আনোয়ার হোসেন অভিনীত চলচ্চিত্রের সংখ্যা কত তার হিসেব করা কঠিন। কোন কোন সুত্র লিখেছে পাঁচ শতাধিক। তবে কেউ কেউ এটা মানতে নারাজ, তাদের মতে বড়ো জোর সাড়ে চারশত। ১৯৪০ সালে দেওয়ানগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন, সেখান থেকে জামালপুর জেলা স্কুলে। সে সময়ই নাটকে অভিনয়ের প্রতি তাঁর প্রচন্ড আগ্রহ ছিলো। স্কুল বা এলাকায় নাটক হলে, ছুটে যেতেন। যে কোন ধরনের চরিত্রে অভিনয়ের সূযোগ পেলেই খুশি, হোক তা ছোট। ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ভর্তি হন ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে। সেখানে আসকার ইবনে শাইখের ‘পদক্ষেপ’ নাটকে অভিনয় করে প্রশংসিত হন। ১৯৫৭ সালে চাকরির সুবাদে তিনি ঢাকায় আসেন। ১৯৫৯ সালে তিনি ননী দাসের নির্দেশনায় ‘এক টুকরো জমি’ নাটকে অভিনয় করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এ সময় তিনি ঢাকা বেতারে অডিশন দিয়ে শিল্পী হিসেবে উত্তীর্ণ হন। মঞ্চ ও বেতারে নিয়মিত নাটক করার সুবাদে আবদুল জব্বার খান, মহিউদ্দিন, মোহাম্মদ আনিস, হাবিবুর রহমান প্রমুখ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচিত হন। এ সময় ঝিনুক পত্রিকার সম্পাদক আসিরুদ্দিন আহমেদের উদ্যোগে গঠিত হয় মিনার্ভা থিয়েটার। এতে আনোয়ার হোসেন, সৈয়দ হাসান ইমাম, ফতেহ লোহানী, মেহফুজ, সুভাষ দত্ত, চিত্রা সিনহা প্রমুখ যুক্ত ছিলেন। আনোয়ার হোসেনের প্রথম ছবি মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘তোমার আমার’ মুক্তি পায় ১৯৬১ সালে। ওই ছবিতে খল চরিত্রে অভিনয় করেও তিনি প্রশংসিত হন। তবে একই বছর মুক্তিপ্রাপ্ত “সূর্যস্নান” ছবির প্রধান চরিত্রে (নায়ক) অভিনয় করে তিনি যেন প্রমাণ করে দেন নিজেকে। এরপর জোয়ার এলো, কাঁচের দেয়াল, নাচঘর, দুই দিগন্ত, বন্ধন, একালের রূপকথা সহ বেশ কটি ছবিতে নানা ধরনের চরিত্রে তাঁর সাবলীল অভিনয় মুগ্ধ করে সকল শ্রেণীর দর্শককে। ১৯৬৭ সালে মুক্তি পায় তার ‘নবাব সিরাজুদ্দৌলা’ ছবিটি। নাম ভুমিকায় অভিনয় করেন আনোয়ার হোসেন। এই ছবির ব্যাপক সাফল্য তাকে নিয়ে আসে একমুখি চরিত্রে। প্রতিবাদী, দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত আপোষহীন, সামাজিক ভাঙনেও অটল এমন সব চরিত্রেই এই অভিনয় শিল্পীকে ছবিতে নিতে ব্যাকুল থাকতেন নির্মাতারা।বহুমুখী চরিত্রের এই অভিনেতা যেন একমুখী চরিত্রে অপরিহার্য হয়ে ওঠেন। স্বাধীনতার পর রাজেন তরফদার পরিচালিত, যৌথ প্রযোজনার ‘পালঙ্ক’ ছবিতে উৎপল দত্ত এবং সন্ধ্যা রায়ের সঙ্গে আনোয়ার হোসেনের সাবলীল এবং অনবদ্য অভিনয় আবারও বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বংগে প্রমান করে দেয় তিনি কতো বড়ো মাপের শিল্পী। সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ সহ আরও দু’তিনটি ছবিত আমরা এর ব্যতিক্রম দেখলেও, সে ছবিগুলো ব্যবসায়িক ভাবে সুবিধা করতে না পারায়, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তিনি সেই ‘মুকুট হীন নবাব’ অভিব্যক্তিতেই স্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পীদের মধ্যে তিনিই প্রথম পেয়েছেন একুশে পদক। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তিনি অর্জন করেন শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার। আরও দুইবার পেয়েছেন পার্শ্ব চরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনয়ের পুরস্কার। পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা। এছাড়া বাচসাস সহ পেয়েছেন, দেশ ও বিদেশের বেশ কটি পুরস্কার, পদক ও সম্মাননা। ১৯৩১ সালের ৬ নভেম্বর, জামালপুরে জন্মগ্রহণ করেন আনোয়ার হোসেন। জন্মদিনে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এ দেশের চলচ্চিত্রের এই ‘মুকুট হীন নবাব’ এঁর স্মৃতির প্রতি।
মুজতবা সউদ