ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিস্মরণীয় শব্দযূথ ইনকিলাব জিন্দাবাদের অনুপ্রেরণায় তাঁর প্রথম নামকরণ হয়েছিল ‘ইনকিলাব’। পরে তাঁর নাম বদলে রাখা হয় অমিতাভ অর্থাৎ ‘যে আলো নির্বাপিত হয় না।’ তিনি ‘বিগ বি’ এবং ‘শাহেনশাহ’ নামেও পরিচিত। তিনি অমিতাভ হরিবংশ বচ্চন বা অমিতাভ বচ্চন। অমিতাভ বচ্চনের পিতা হরিবংশ রাই বচ্চন একজন নামকরা হিন্দি কবি ছিলেন। তাঁর মা তেজি বচ্চন ফৈসলাবাদের (এখন পাকিস্থানে) এক শিখ-পঞ্জাবী। যদিও তাঁদের পদবী ছিলো শ্রীবাস্তব কিন্তু তাঁর বাবা নিজের লেখা প্রকাশ করার সময় যে ছদ্ম-পদবী ‘বচ্চন’ ব্যবহার করতেন সেই পদবীটিই তিনি সব জায়গায় ব্যবহার করতে শুরু করেন।
এলাহাবাদের জ্ঞান প্রোবোধিনি এবং বয়েজ হাই স্কুলে অমিতাভ পড়াশোনা করেছেন। পরে নৈনিতালের শেরউড কলেজে কলা বিভাগে পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত কিরোরিমল কলেজ থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক হন।
১৯৬৯-এ বচ্চন ছবির জগতে আত্মপ্রকাশ করেন ‘সাত হিন্দুস্তানি’ নামক একটি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে যেখানে সাতটি প্রধান চরিত্রের একটিতে তিনি অভিনয় করেছিলেন। খাজা আহমেদ আব্বাস নির্দেশিত এই ছবিটিতে অন্যান্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন উৎপল দত্ত, মধু এবং জালাল আগা। যদিও ছবিটি বাণিজ্যিক সাফল্য পায়নি, তবুও বচ্চন এই ছবিতে অভিনয়ের সুবাদে শ্রেষ্ঠ নতুন অভিনেতা হিসেবে তাঁর প্রথম ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ পান।
এরপরে তাঁকে রাজেশ খান্নার সঙ্গে দেখা যায় ‘আনন্দ’ (৭১) ছবিতে যা বাণিজ্যিক সাফল্যর সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্র সমালোচকদের প্রশংসাও আদায় করে। এই ছবিতে বচ্চন ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ সহ অভিনেতার পুরস্কার পান। ‘পরওয়ানা’ (৭১) ছবিতে অমিতাভ একজন মোহগ্রস্থ প্রেমিকের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
১৯৭২ সালে তিনি এস. রামানাথনের নির্দেশিত একটি রোড অ্যাকশন কমেডি ‘বম্বে টু গোয়া’ ছবিতে অভিনয় করেন। এই ছবিতে তাঁকে অরুণা ইরানি, মেহমুদ, আনোয়ার আলি এবং নাসির হুসেনের মতো অভিনেতাদের সঙ্গে দেখা গিয়েছিলো।
১৯৭৩-এ বচ্চনের চলচ্চিত্র জীবনে একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে যখন পরিচালক প্রকাশ মেহেরা তাঁর ‘জঞ্জীর’ (৭৩) ছবির মুখ্য ভূমিকা, ইন্সপেক্টর বিজয় খান্নার চরিত্রে তাঁকে নির্বাচিত করেন। এই ছবিটি আগের সমস্ত রোম্যান্টিক ছবির থেকে পুরোপুরি অন্য ঘরানার হওয়ায় অমিতাভ ‘রাগী যুবক’ হিসেবে এক নতুন রূপে নিজেকে বলিউডে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পেয়েছিলেন।
১৯৭৩ সালে তিনি জয়া ভাদুড়ীকে বিয়ে করেন এবং এই সময়ে একসঙ্গে বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেন। শুধু ‘জঞ্জীর’ই নয় ‘অভিমান’ নামক ছবিটি তাদের বিয়ের এক মাস পরেই মুক্তি পেয়েছিল। এরপর বচ্চন বীরেশ চ্যাটার্জির চিত্রনাট্যে হৃষিকেশ মুখার্জির পরিচালিত সামাজিক ছবি ‘নমক হারাম’-এ বিক্রমের চরিত্রে অভিনয় করেন যার মূল বিষয় ছিল বন্ধুত্ব। রাজেশ খান্না এবং রেখার সঙ্গে তাঁর সহঅভিনেতার ভূমিকায় অভিনয় প্রশংসিত হয় এবং তিনি এই চরিত্রের জন্যে ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ সহ অভিনেতার পুরস্কারও পান।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শোলে’ ভারতের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাণিজ্যিকভাবে সফল চলচ্চিত্র হিসেবে অভিহিত হয়েছিল। মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনা করেও এই ছবির রোজগার হয় প্রায় ২,৩৬,৪৫,০০,০০০ রুপি। এই ছবিতে বচ্চন জয়দেবের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ছবির জগতের অনেক নামজাদা তারকারা, যেমন ধর্মেন্দ্র, হেমা মালিনী, সঞ্জীব কুমার, জয়া ভাদুড়ি এবং আমজাদ খান।
১৯৯৯-এ বিবিসি ইন্ডিয়া এই ছবিটিকে ‘সহস্রাব্দের সেরা ছবি’ বলে ঘোষণা দিয়েছিল। ইন্ডিয়া টাইমস মুভিস ‘দিওয়ার’ ছবির মতো এই ছবিটিকেও প্রথম ২৫টি অবিস্মরণীয় বলিউড ছবির তালিকায় রেখেছে। একই বছরে ৫০তম ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের বিচারকরা এই ছবিটিকে ‘ফিল্মফেয়ার পঞ্চাশ বছরের শ্রেষ্ঠ ছবি’ নামক এক বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেন।
বক্স অফিসে শোলের অভাবনীয় সাফল্যর পর বচ্চন মুম্বাই ফিল্ম জগতে তাঁর জায়গা পাকা করে নেন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত তিনি অজস্র ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার এবং মনোয়ন পেয়েছিলেন।
১৯৭৯ সালে মিস্টার ‘নটবরলাল’ ছবিতে প্রথমবার অমিতাভ নিজের কন্ঠে গান গেয়েছিলেন। এই ছবিতে তাঁর বিপরীতে ছিলেন রেখা। এই ছবিতে তাঁর অভিনয়ের জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পান এবং গানের জন্য ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ পুরুষ নেপথ্য গায়কের পুরস্কারের জন্যও মনোনয়ন লাভ করেছিলেন।
১৯৭৯-এ তিনি আবার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার বিভাগে মনোনয়ন পান ‘কালা পাত্থার’ (৭৯) ছবির জন্যে। রাজ খোসলা পরিচালিত ছবি ‘দোস্তানা’ এর জন্যও ১৯৮০-তে মনোনয়ন পান। এই ছবিতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন শত্রুঘ্ন সিংহ এবং জিনাত আমান। ১৯৮১-তে তিনি যশ চোপড়ার আবেগধর্মী ছবি ‘সিলসিলা’ তে অভিনয় করেন। এই ছবিতে তাঁর বিপরীতে ছিলেন তাঁর স্ত্রী জয়া এবং রেখা– যাঁকে তার প্রেমিকা হিসেবে সন্দেহ করা হত।
অনান্য ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য- রাম বলরাম (৮০), শান (৮০), লাওয়ারিস (৮১) এবং শক্তি (৮২)। শেষ ছবিতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা দিলীপ কুমার— যাঁকে তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা এবং মহাতারকা হিসেবে গণ্য করা হতো।
১৯৮৪ সালে তাঁদের অনেকদিনের পারিবারিক বন্ধু রাজীব গান্ধীর সমর্থনে অমিতাভ অভিনয় থেকে সংক্ষিপ্ত বিরতি নিয়ে রাজনীতিতে যোগ দেন। তিনি এলাহাবাদ লোকসভা আসনের জন্য উত্তর প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এইচ এন বহুগুনা-র বিরুদ্ধে নির্বাচন করে জয়লাভ করেন। তাঁর রাজনৈতিক কর্মজীবন সংক্ষিপ্ত ছিল।
১৯৮৮ সালে ‘শাহেনশাহ’ ছবিতে নামভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমে বচ্চন চলচ্চিত্র জগতে প্রত্যাবর্তন করেন।
তাঁর স্বল্পকালীন অবসর জীবনে বচ্চন প্রযোজনার কাজে হাত দেন। তিনি ‘অমিতাভ বচ্চন কর্পোরেশন লিঃ (ABCL) স্থাপন করেন। ১৯৯৭-এ ABCL দ্বারা প্রযোজিত ‘মৃত্যুদাতা’ ছবির মাধ্যমে বচ্চন, অভিনয়ে প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করেন। মৃত্যুদাতা বচ্চনের পুরনো একশনধর্মী চরিত্রকে পুনর্নির্মাণ করতে চাইলেও বাণিজ্যিকভাবে তা সফল হয়নি।
বচ্চন তাঁর অভিনয় জীবনে পুরোপুরি ফিরে আসার জন্যে ‘বড়ে মিয়া ছোটে মিয়া’র (৯৮) মতো মাঝারি মাপের ছবির সাহায্য নেন। ‘সূর্যবংশম’ (৯৯) ছবিতে তাঁর অভিনয়ের জন্যে প্রশংসা পেলেও ‘লাল বাদশাহ’ এবং ‘হিন্দুস্তান কি কসম’ (৯৯) বক্স অফিসে ব্যর্থ হয়েছিল।
২০০০ সালে বচ্চনকে ব্রিটিশ টেলিভিশন গেম শো ‘হু ওয়ান্টস টু বি আ মিলিয়নেয়ার?’-এর ভারতীয় সংস্করণের সঞ্চালক হিসেবে দেখা গিয়েছিল। যার নতুন নাম হয়েছিল ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’। অন্যান্য দেশের মতই (যেখানে এটি গৃহীত হয়েছে) এই অনুষ্ঠানটি তাৎক্ষণিক সাফল্য পেয়েছিল।
২০০০-এ অমিতাভ বচ্চন যশ চোপড়ার বক্স অফিসে সফল ছবি ‘মোহাব্বতে’-তে অভিনয় করেন। ছবিটি পরিচালনা করেন আদিত্য চোপড়া। এসময় আরো অভিনয় করেন ‘রিস্তাঃ দ্য বন্ড অফ লাভ’, ‘কভি খুশি কভি গম’ (০১) এবং ‘বাগবান’ (০৩) ছবিতে তাঁকে দেখা যায় পরিবারের সর্বময় কর্তার ভূমিকায়।
‘আক্স’ (০১), ‘আঁখে’ (০২), ‘খাকি’, ‘দেব’ (০৪) এবং ‘ব্ল্যাক’ (০৫) সমালোচকদের দ্বারা উচ্চপ্রশংসা লাভ করে। ২০০৫ এবং ২০০৬-এ তিনি তাঁর ছেলে অভিষেকের সঙ্গে সফল ছবি ‘বান্টি অর বাবলি’ (০৫), গডফাদারকে সম্মান জানিয়ে তৈরি হওয়া ভারতীয় ছবি ‘সরকার’ (০৫) এবং ‘কভি অলবিদা না কহেনা’ (০৬)-তে কাজ করেন।
প্রত্যেকটি ছবিই বক্স অফিসে সাফল্য পায়। ২০০৬ এবং ২০০৭-এর মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির মধ্যে ছিলো ‘বাবুল’ (০৬), ‘একলব্য’ এবং ‘নিঃশব্দ’ (০৭) যেগুলি বক্স অফিসে ব্যর্থ হয় কিন্তু প্রত্যেকটি ছবিতে তাঁর অভিনয় ভূয়সী প্রশংসা লাভ করে।
মে ২০০৭-এ তাঁর দুটি ছবি ‘চিনি কম’ এবং অনেক তারকা সমৃদ্ধ ‘শ্যুট আউট অ্যাট লোখন্ডওয়ালা’ মুক্তি পায়। শ্যুটআউট অ্যাট লোখন্ডওয়ালা বক্স অফিসে খুব ভালো ফল করে এবং ভারতে ছবিটি হিট বলে ঘোষণা করা হয়। চিনি কম প্রথমে খুব ভালো ফল দেখাতে না পারলেও পরে মাঝারি ধরনের হিট হিসেবে ঘোষিত হয়।
৯ সেপ্টেম্বর ২০০৭-এ তাঁর প্রথম ইংরেজি ছবি ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’ ২০০৭-এর টরন্টো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রিমিয়ার শো করে। সমালোচকরা তাঁর কাজের প্রশংসা করেন এবং ‘ব্ল্যাক’ এর পরে তাঁর এই ছবির অভিনয়কেই সেরা বলে দাবি করেন। ‘ভূতনাথ’ নামে যে ছবিতে তিনি নামভূমিকায় এক অশরীরীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন তা মুক্তি পায় ৯ মে ২০০৮ এ। ‘সরকার রাজ’ মুক্তি পায় জুন ২০০৮-এ।
২০০৫-এ তৈরি ছবি সরকার এর পরবর্তী গল্পই এই ছবির বিষয়বস্তু। বক্স অফিসে সরকার রাজ ইতিবাচক ফল করে। তার পরবর্তী ছবি ‘পা’ ২০০৯ এর শেষের দিকে মুক্তি পায়, যেখানে খুব অপ্রত্যাশিত ভাবেই অভিতাভকে তাঁর ছেলে অভিষেকের প্রোগেরিয়া রোগে আক্রান্ত ১৩ বছর বয়সী ছেলের ভূমিকায় দেখা যায়। এ ছবিতে অমিতাভ বচ্চনের অভিনয় বিশেষ ভাবে প্রশংসিত হয়।
অমিতাভ বচ্চন তাঁর গম্ভীর, ব্যারিটোন কন্ঠস্বরের জন্যে বিখ্যাত। তাঁকে অজস্র অনুষ্ঠানে সূত্রধর, নেপথ্য গায়ক এবং উপস্থাপকের ভূমিকায় দেখা গেছে। প্রথিতযশা চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় বচ্চনের কন্ঠস্বর শুনে এতো মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি তাঁর ছবি ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’-তে তাঁকে ভাষ্যকারের ভূমিকা দিয়েছিলেন কারণ ছবিতে তাঁর উপযুক্ত কোনো চরিত্র ছিলো না।
অমিতাভ বচ্চন নিজের কর্মজীবনে তিনটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং বারোটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার সহ অজস্র গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার পেয়েছেন। ফিল্মফেয়ারের শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কারের বিভাগে তিনি সর্বাধিক মনোনয়ন পাওয়ার রেকর্ড করেছেন। অমিতাভ বচ্চন ১৯৪২ সালের ১১ অক্টোবর এলাহবাদে জন্মগ্রহণ করেন।
গোপাল দেবনাথ, কলকাতা