সাংবাদিকদের পাশে আছেন প্রধানমন্ত্রী : মোল্লা জালাল

করোনা মহামারীর এই সময়ে দেশে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সেনা সদস্যদের পাশাপাশি সাংবাদিকরা সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এ কাজে সম্পৃক্ত সকলের সুরক্ষা থাকলেও সাংবাদিকদের নেই। এর বাইরেও ছাঁটাই, বেতন না দেয়া, কমিয়ে দেয়া ইত্যাদি নানা নিপীড়নের মধ্যেও সাংবাদিকরা দায়িত্ব পালন থেকে বিরত হয়নি। এসব নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। ইউনিয়নের পক্ষ থেকে দাবি-দাওয়া, দেন-দরবার, আন্দোলন সংগ্রাম কম হয়নি। এখনও হচ্ছে। কিন্তু তাতেও ছাঁটাই বন্ধ হচ্ছে না। এহেন পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য বিএফইউজে ও ডিইউজে নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানায়। তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপি শুরু থেকেই সাংবাদিকদের সমস্যাগুলো সম্পর্কে জানতেন। তিনি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সবকিছু অবহিত করলে মানবতার প্রতীক, সাংবাদিকবান্ধব প্রধানমন্ত্রী এই দুঃসময়ে সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়ান। তিনি আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে সাংবাদিকদের সাহস দেয়ার পদক্ষেপ নেন যা ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। শুধু করোনাকালেরই নয়, তিনি সাংবাদিকদের কল্যাণে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট।’ ওই ট্রাস্টের মাধ্যমে সারা বছর ধরে সাংবাদিকদের আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়ে থাকে। ট্রাস্ট থেকে আবেদনকারীরা সর্বনিম্ন ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকেন। এছাড়াও তিনি প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের দুঃসময়ে বিপুল অঙ্কের চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করেন। উপমহাদেশে বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তানসহ বিশ্বের কোথাও করোনা মহামারীর এই সময়ে সাংবাদিকদের পাশে কোন সরকার প্রধানের দাঁড়ানোর এ রকম নজির নেই। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই পদক্ষেপ একটি অনুশীলনীয় দৃষ্টান্ত। সাংবাদিক সমাজ প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ।
সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশেও করোনা মহামারীর কারণে নানা ধরনের সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে এবং হচ্ছে। সরকার সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সকল সঙ্কট মোকাবেলা করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সেক্টরে হাজার হাজার কোটি টাকা প্রণোদনার প্যাকেজ দিয়েছে, প্রায় ৮ কোটি মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দিয়েছে, এখনও দিয়ে যাচ্ছে। প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় বেসরকারী খাতের সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দেশের গণমাধ্যমও বেসরকারী খাতের শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আগে দেশে দুই ধরণের গণমাধ্যম ছিল। সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থা। বর্তমানে যুক্ত হয়েছে টেলিভিশন এবং অনলাইন। এখন সাংবাদিকদের বলা হয় গণমাধ্যমকর্মী। যদিও ‘সাংবাদিক’ আর ‘গণমাধ্যমকর্মী’ শব্দ দু’টির মর্যাদায় পার্থক্য আছে। ‘সাংবাদিক’ শব্দটা সর্বসাধারণের কাছে অনেক বেশি মর্যাদাবান। ‘কর্মী’তো যে কেউ-ই। সরকার বেসরকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ইনসেনটিভ দেয় না। ব্যতিক্রম শুধু সংবাদপত্র এবং কমবেশি অন্য গণমাধ্যম। সংবাদপত্রে সরকার সারা বছর ধরেই সহযোগিতা দিয়ে থাকে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়, বিজ্ঞাপনের ইনসার্সন বাড়ায়, ইনকাম ট্যাক্স সুবিধা, এ্যাক্রেডিশন কার্ড, নিউজ পেপারের কোটা, জমিজমা, ব্যাংক লোন সুবিধাসহ গণমাধ্যম মালিকদের সিন আনসিন অনেক সুবিধা আছে। যার ফলে সারাদেশে হাজার হাজার সংবাদপত্র, প্রায় অর্ধশতাধিক টিভি চ্যানেল, অনলাইন নিউজ পোর্টাল চালু রয়েছে। প্রতিদিন অনলাইন-অফলাইনের সংখ্যা বাড়ছেই। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে ইউটিউব টিভি চ্যানেল। প্রথম আলোসহ বহু পত্রিকা অনলাইন নিউজপোর্টাল করার পর এখন ইউটিউব চ্যানেল চালু করছে। অথচ এগুলোর কোন সরকারী অনুমোদন নেই। এসব প্রতিষ্ঠানে সরকার সরাসরি কোন ইনসেনটিভ দেয় না। সরাসরি দেয় শুধু পত্রিকায় আর পরোক্ষাভাবে পায় টিভি চ্যানেল। করোনা মহামারীর সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর সবার আগে গণমাধ্যম মালিকরা তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করে কিছু দাবি জানায়। দাবি ছিল প্রণোদনার। যুক্তি ছিল সরকার প্রণোদনা না দিলে তারা প্রতিষ্ঠান চালাতে পারছে না। টাকার অভাবে সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশে মার্চের ৮ তারিখে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এই খবর সকল মহলে জানাজানি হতে আরও ১০/১৫ দিন সময় লাগে। এরই মাঝে দেশের গণমাধ্যম মালিকদের সংগঠনগুলো করোনার কারণে তাদের আর্থিক সঙ্কটের কথা জানায়। অনেকে শুরু করেন ঢালাওভাবে ছাঁটাই। একের পর এক পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়। যেসব পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীদের পথে বসানো হয় সেসব পত্রিকা চালু রাখে ‘অনলাইন’। তার মানে সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীবিহীন ‘লাভের দোকান’। এ সময় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে মালিকদের বার বার অনুরোধ করা হয় তারা যেন ঢালাওভাবে ছাঁটাই বন্ধ করেন। এ দাবিতে ইউনিয়ন নিয়মিত মিটিং, মানববন্ধন করতে শুরু করে। ততদিনে শতশত সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করে পথে বসাতে বাধ্য করা হয়। ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বিএফইউজে ও ডিইউজে নেতারা তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করে এ বিষয়ে তাকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানায়। তথ্যমন্ত্রী সেদিনের পর থেকে প্রায় প্রতিদিন গণমাধ্যম মালিকদের প্রতি এই সময়ে ছাঁটাই না করার অনুরোধ জানান। কিন্তু অনেকেই তা শোনেনি। বরং তথ্যমন্ত্রী যখন বার বার তাদের প্রতি ছাঁটাই বন্ধ করে বেতন-ভাতা প্রদানের জন্য বলতে শুরু করেন, তখন মালিকরা আবার তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করে দাবি জানায়, তাদের বকেয়া প্রায় ১’শ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন বিল পরিশোধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। তথ্যমন্ত্রী উদ্যোগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানে গণমাধ্যম মালিকদের পাওনা বকেয়া বিজ্ঞাপন বিলের প্রায় ৮০ কোটি টাকা পরিশোধের ব্যবস্থাও করেন। এই বিপুল পরিমাণ টাকা পাওয়ার পরও অধিকাংশ সংবাদপত্রের মালিক সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া বেতন-ভাতা দেয়নি, ছাঁটাই বন্ধ করেনি, ঈদ-উল-ফিতরে বোনাস দেয়নি। এ অবস্থায় বিএফইউজে ও ডিইউজে নেতারা তথ্যমন্ত্রীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে করোনাকালীন সময়ে সাংবাদিকদের আর্থিক সহায়তার আবেদন জানায়। তথ্যমন্ত্রী ইউনিয়নের আবেদনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করলে প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের অসহায় অবস্থাকে বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে তথ্যমন্ত্রীকে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বলেন। একই সঙ্গে তিনি মালিকদের প্রতিও আহ্বান জানান যাতে এ সময়ে কেউ সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীদের ছাঁটাই না করে। এদিকে ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সারাদেশে বিএফইউজের অনুমোদিত সকল ইউনিটের সকল সদস্যসহ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে করোনাযোদ্ধা হিসেবে মাঠে-ময়দানে থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালনরত মূলধারার সাংবাদিকদের আর্থিক সহায়তার জন্য তালিকা প্রস্তুত করে। সেই তালিকার ভিত্তিতে সরকার বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে প্রথম দেড় হাজার সাংবাদিককের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে করোনাকালীন সহায়তা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিক তালিকা প্রণয়নের জন্য তিনটি ক্রাইটেরিয়ার উল্লেখ করে একটি আবেদন ফরম বানানো হয়। যদিও অনেকেই তখন এই সিদ্ধান্ত অকার্যকর করার জন্য সক্রিয়ভাবে মাঠে নামে। তারা সাংবাদিকদের নানা ধরনের রিলিফ সামগ্রী দেয়ার প্রস্তাব দিয়ে সরকারকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালায়। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু করা হয় ব্যাপক অপপ্রচার। একটি সুবিধাভোগী মহল সোচ্চার হয় ইউনিয়নের উদ্যোগ বানচাল করার জন্য। এ অবস্থায় বিএফইউজে ও ডিইউজে নেতৃত্ব সকল বিরোধিতার যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়ে সরকারকে ইউনিয়নের দাবির যৌক্তিকতা বোঝাতে সক্ষম হয়। এদিকে বিষয়টি যখন চূড়ান্ত হয়ে যায়, ঠিক তখনই প্রেস কাউন্সিল থেকে একটি চিঠি দিয়ে সারাদেশের জেলা প্রশাসকদের বলা হয়, সরকার সাংবাদিকদের আর্থিক সহায়তা দেবে। তারা যেন দ্রুত তালিকা তৈরি করে পাঠায়। এর ফলে চরম বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। একদিকে ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তথ্যমন্ত্রীকে সাংবাদিকদের তালিকা দেয়া হয়েছে, অপরদিকে প্রেস কাউন্সিল থেকে তালিকা চাওয়া হচ্ছে। এ বিষয়টি জানতে পেরে বিএফউজের সভাপতি, মহাসচিব, ডিইউজে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করে ঘটনাটি অবহিত করলে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে প্রেস কাউন্সিলের চিঠি বাতিল করার নির্দেশ দিলে চক্রান্ত ব্যর্থ হয়। তার বলিষ্ঠ পদক্ষেপের ফলে করোনাকালীন পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের আর্থিক সহায়তার তহবিলে আরও অর্থের যোগান বাড়ে। এতে ইউনিয়নের সদস্যদের বাইরে সারাদেশে করোনাযোদ্ধা সাংবাদিকদের সহায়তা দেয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত হয়। ফলে দেশের ৬৪ জেলায় দল-মত নির্বিশেষে সাংবাদিকরা এই সহায়তা পেয়েছেন।
আলমগীর কবির