এই টাওয়ারটি দেখলেই সবার মনে প্রথম যে কথাটি মনে পড়ে কেন হেলে রয়েছে , আমার ছোট বেলা থেকেই এই একই কথা মনে হতো। ছোটবেলায় আমি কাজিনে বাসার ছবি দেখেছি তিনি এর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, তখন থেকেই মনে, একদিন এটা দেখব বলে চিন্তা করেছিলাম। ইতালির ভিসা পেয়েছিলাম 2010 সালের নভেম্বর মাসে প্রথম বার, তখন ইটালিতে আসতে পারিনি টিকেটের দাম বেশি ছিল বলে। সেজন্য পরবর্তীতে সবসময়ই আফসোস থেকে গিয়েছে ইতালিতে আসার, স্পেশালি এই বিল্ডিংটি দেখার ভিতরে আমার বেশ কৌতূহল ছিল ছোটবেলা থেকেই। সর্বশেষে 20 শে নভেম্বর 2019 সালে, দেখার সেই সৌভাগ্য টি হল। দেখি সাদা শ্বেত পাথরের এই বিল্ডিংটি কে মুগ্ধ হয়ে দাড়িয়ে থাকি। এটি হচ্ছে গির্জার বেল টাওয়ার, যেখান থেকে প্রতিদিন সকাল 7 টা 8:30 এবং 9 টা 45 এ এবং 12 টায় ঘন্টা বাজানো হয় এসেম্বলি সময় ।ইতালিতে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে যা কিছুই তৈরি করে তা বেশ অনেক দিনই লাগে এটা তৈরি করতে প্রায় 99 বছর 100 বছর লেগেছে। 1173 সালে এটি নির্মাণ কাজ শুরু করে এবং শেষ হয় 1172 এতো সালে।ভূমি থেকে অষ্টতলাবিশিষ্ট এ মিনারের উচ্চতা প্রায় ৫৬ মিটার। এর সর্বমোট ওজন প্রায় ১৪,৫০০ টন। বর্তমানে এটি প্রায় ৩.৯৯ ডিগ্রী কোণে হেলে রয়েছে। এর ২৯৪টি সিঁড়ি আছে।
১১৭৮ সালে মিনারটির তৃতীয় তলা নির্মাণের পর এটি হেলতে শুরু করে। নরম মাটিতে মাত্র তিন মিটার গভীরতায় এর ভিত্তি গড়ে তোলাই মিনারটির হেলে পড়ার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এছাড়া মিনারের নকশাও এজন্যে কিছুটা দায়ী। অবকাঠামোটির নির্মাণকার্য শতাধিক বছর বন্ধ ছিল। কারণ পিসার অধিবাসীরা প্রায়শঃই জেনোয়া, লুক্কা এবং ফ্লোরেন্সের সাথে যুদ্ধকর্মে লিপ্ত থাকতো।
পিসার হেলানো মিনারটির প্রকৃত স্থপতি কে ছিলেন তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। অনেক বছর ধরেই গাগলিমো এবং বোনানো পিসানোকে এর নকশাকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তন্মধ্যে বোনানো পিসানো ছিলেন দ্বাদশ শতকের সুপ্রসিদ্ধ পিসা নগরীর অধিবাসী ও শিল্পী। তিনি ব্রোঞ্জ দিয়ে গড়া পিসা দুমো’র জন্যেও স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি ১১৮৫ সালে পিসা ত্যাগ করে সিসিলি’র মনরিলে এলাকায় চলে যান এবং নিজ শহরে ফিরে আসা মাত্র দেহত্যাগ করেন। এভাবেই বর্ণনা করে গিয়েছে আমার গাইড, তারপরে ১৮২০ সালে টাওয়ারের পাদদেশে তাঁর নামাঙ্কিত এক টুকরো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু এটি ১৫৯৫ সালে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ক্যাথেড্রেলের ব্রোঞ্জের দরজার সাথে সম্পর্কিত ছিল। কিন্তু পরে সাম্প্রতিককালের গবেষণায় দেখা গেছে যে, দিওতিসালভি নামক এক ব্যক্তি পিসার হেলানো মিনারের প্রকৃত স্থাপত্যবিদ। নির্মাণকার্যের সময়কাল, দিওতিসালভির কাজ-কর্ম, স্যান নিকোলা মিনারের ঘন্টা ইত্যাদিতে এর প্রতিফলন ঘটেছে। সচরাচর তিনি তাঁর কাজগুলোয় স্বাক্ষর করতেন কিন্তু মিনারের ঘন্টায় তিনি কোন স্বাক্ষর করেননি।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই দিনটিকে ব্যবহার করা হতো শত্রুদের পর্যবেক্ষণ করার জন্য।সেনাবাহিনীর একজন সার্জেন্ট জার্মান বাহিনীর অবস্থান নিশ্চিত করতে মিনারটিতে যান। তিনি মিনারের শৈল্পিক দক্ষতায় অভিভূত হন এবং ক্যাথেড্রালের সৌন্দর্য্য উপভোগ শেষে সেনাবাহিনীকে মিনার আক্রমণ না করতে নির্দেশ দেন। এভাবেই মিনারটি নিশ্চিত ধ্বংসের মুখোমুখি থেকে রক্ষা পায়।
সাদা কারুকার্য কাছে সুন্দরভাবে হেলানো আকৃতি হৃদয়কে ছুঁয়ে দেয়, আর চার্জের সাথে রয়েছে তিনটি দম। ওখানে রয়েছে শিল্পে কার্য এবং শিল্পীদের আঁকা বিভিন্ন ছবি যা দেখলে হৃদয় জুড়িয়ে যায়।
এই হেলানো টাওয়ার থেকে দেখতে আপনাকে গুনতে হবে 18 ইউরোপ, একটু বেশি। আর তিনটি ডম সহ চারটি ডুম যদি দেখতে চান তাহলে গুনতে হবে আরো নয় ইউরোপ। বাইরে থেকে ছবি তুলতে সম্পূর্ণ ফ্রি। আরে টা খোলা থাকে সকাল থেকে রাত 8 টা পর্যন্ত শীতকালে আর গরমকালে রাত দশটা পর্যন্ত। রুম থেকে মাত্র সময় লাগে লোকাল ট্রেনে আসতে চার ঘণ্টা মাত্র 24 ইউরো, আর বাস তো আছেই তাতে আরো সস্তায় আসা যায় এখানে।হোটেলের তাও খুব একটা বেশি না 40 থেকে 60 ইউরও ভিতরে খুব ভালোই দুজনের জন্য হোটেল পাওয়া যায়। আর হোস্টেলেও খুব সস্তা মোটামুটি বেকারদের জন্য 20 থেকে 25 ইউরো দিন কাটিয়ে দেয়া যায়।
কাজী আসমা আজমেরী