মাদক দানব চূড়ান্তভাবে পরাজিত হবেই : বেনজীর আহমেদ

সম্প্ররতি দূর প্রতিবেশী একটি দেশের পরিচিত এক বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা একটি নিরাপত্তা গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে ‘বর্তমান শতকে জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অপ্রচলিত ও অপ্রথাগত হুমকি ও ঝুঁকির বিষয়ে’ প্যানেল বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ক্রমান্বয়ে দেশে দেশে প্রথাগত ও সর্বাত্মক যুদ্ধের ঘটনা কমে এসেছে। বাণিজ্যযুদ্ধ এখন সেখানে স্থান নিয়েছে। সামনে আসছে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। এখানেও আসলে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ও তথ্যের ওপর দাদাগিরির লড়াই। এরই মধ্যে সে লড়াইয়ের তীব্রতাও উন্মোচিত হতে শুরু করেছে।
এখন অপ্রচলিত কিন্তু ভয়াবহ ভিন্নতর নিরাপত্তা ঝুঁকি বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থিত। উগ্রবাদ এমনই একটি ঝুঁকি। অবয়বহীন, সীমানাবিহীন, রাষ্ট্র কাঠামোবহির্ভূত এ অপশক্তির ধ্বংস থেকে কোনো দেশই আজ নিরাপদ নয়। স্বাদুপানি কমে আসছে। স্বাদুপানির অভাবে জমি নিষ্ফম্ফলা হবে, বন-প্রান্তর হবে মরুভূমি, মানববসতি উজাড় হবে। একটি ভৌগোলিক চার সীমানার মধ্যে মানুষই যদি না থাকে, রাষ্ট্র টিকবে কীভাবে। সে ক্ষেত্রে নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা এমন যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। মানবসৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয়ও একই পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এ ধরনের অপ্রথাগত, অপ্রচলিত বিষয়গুলো চলতি শতকে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য নতুন নতুন হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও বিশ্নেষকদের কাছে বিশ্বব্যাপী এগুলো শনাক্তকরণই আজকের দিনে নতুন চ্যালেঞ্জ।
মাদক ব্যবসা এবং মাদকাসক্তিও তেমনিভাবে জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি মারাত্মক একটি হুমকি। মাদকের অর্থনীতির কাছে ক্রমান্বয়ে দেশের প্রথা, প্রতিষ্ঠান, পেশার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ পরাস্ত হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের সমাজ, রাজনীতি, উপরি কাঠামো ইত্যাদি আক্রান্ত হয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেতর থেকে নড়বড়ে হয়ে পড়ে। লাতিন আমেরিকার কতিপয় দেশ এর জলজ্যান্ত উদাহরণ। আমাদের দেশে মাদকের মারাত্মক নেটওয়ার্ক শুরু হয় মূলত আশির দশকে একশ্রেণির নেশাখোর কর্তৃক ব্যবহূত ফেনসিডিল উৎপাদন ও বিতরণ নিষিদ্ধ করার পর থেকে। তারপর ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে মাদক চোরাকারবারিরা অতিরিক্ত কোডিনযুক্ত অবৈধ ফেনসিডিল পাচার করে দেশে এনে কোটি কোটি টাকা লুট শুরু করে। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে, তখন ঘুমের বড়ি খেয়ে নেশা করতে দেখেছি, সেটিও বেশ চালু ছিল, পরে নেশাখোররা বড়ি বাদ দিয়ে বা পাশাপাশি ঘুমের ইনজেকশনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। চলতি দশকের আগের দশকের প্রারম্ভে আমিন হুদা গং বাংলাদেশে ইয়াবার আমদানি ও প্রচলন করলে বাংলাদেশের মাদকের মানচিত্রে বিপর্যয়কর সৃষ্টি হয়। ইয়াবা পরিবহনে সুবিধা, লাভ বেশি। ইয়াবার আগ্রাসনে একসময় দেশ প্রায় জিম্মি হওয়ার দশায় উপনীত হতে থাকে। একটা সময় সবার মনে হচ্ছিল, কারোর হয়তো কিছুই করার নেই।
২০১৬ সালে শুরুর দিকে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রায়ই আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে করণীয় ও সম্ভাব্য কর্মকৌশল নির্ধারণের জন্য তাগিদ দিতে শুরু করেন। কোনো কিছু সম্পর্কে একটি কার্যকর কৌশল নির্ধারণ করতে হলে বিষয়টির গভীরে প্রবেশ করা প্রয়োজন। এ কাজে প্রথমে তখন সব গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে মাদক ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা সংগ্রহ করে পরে একটি সমন্বিত তালিকা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

সে বছরে, ৩ মে ২০১৬, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী র‌্যাব ফোর্সেস প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে র‌্যাব ফোর্সেসকে মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ প্রদান করেন। আমাদের হাতে তালিকা ছিল। আমরা সেদিন দিবাগত রাত থেকে সরকারপ্রধানের নির্দেশ তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিই।
পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে পূর্বে উল্লেখিত সমন্বিত তালিকা দ্রুত সম্পাদনের বিষয়টি ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করি। কক্সবাজার ইয়াবা প্রবেশের সিংহদ্বার, আমরা সেখানে সাতটি অস্থায়ী র‌্যাব ক্যাম্প স্থাপন করি। হাজার হাজার ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার ও মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সাজা প্রদান করা হয়। ২০১৭ সালের শুরুতে মাদক মামলার আসামিতে জেলখানা উপচে পড়তে শুরু করে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর ক্রমাগত চাপের মুখে মাদক ব্যবসায়ীরা এখন বারবার রুট ও পদ্ধতি পাল্টানোর কৌশল অবলম্বন করছে। বাংলাদেশের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে অবস্থিত মিয়ানমার থেকে মাদক ব্যবসায়ীরা উত্তর-পূর্ব ভারত হয়ে সিলেটের মাধ্যমে মাদক আমদানির চেষ্টা করেছে। আর কৌশল…? আমাদের চোখ এড়ানোর জন্য কখনও গ্যাস সিলিন্ডারের ভেতর, বাস/ট্রাকের বডির ভেতর, জ্বালানি ট্যাঙ্কের ভেতর, সবজি যেমন- বেগুন, কুমড়ো, লাউয়ের মধ্যে, ফার্নিচারের ফ্রেমের ভেতর করে ইয়াবা পাচার করার চেষ্টা হয়েছে। প্রতিবার তারা ব্যর্থ হচ্ছে। এ যুদ্ধে র‌্যাব ফোর্সেসের সদস্যরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে যে ঈর্ষণীয় দেশপ্রেম ও পেশাগত দায়িত্ব নিয়ে কর্তব্য পালন করেছে এবং করে যাচ্ছে, সমগ্র দেশবাসী নিশ্চয় সে অবদান স্বীকার করেন। বিশেষ করে যেসব অফিসার ও ফোর্স জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন, মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন- তাদের বীরত্ব গাথা অনির্বাণ। আমি বাহিনীপ্রধান হিসেবে তাদের সবার জন্য গর্বিত। সেইসঙ্গে অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গৌরবময় অবদান অনস্বীকার্য।
একজন ল এনফোর্সমেন্ট প্র্যাকটিশনার হিসেবে আমরা জানি, শুধু গ্রেফতার, হাজতবাস কিংবা রোবাস্ট ল এনফোর্সমেন্টের মাধ্যমে মাদক সমস্যার সমাধান করা যায় না। পৃথিবীর কোনো আক্রান্ত দেশেই সেটি করা যায়নি। বিশ্বের দেশে দেশে মাদকবিরোধী অভিযানের অনেক উদাহরণ রয়েছে। সেসব দেশের রয়েছে মাদকবিরোধী অভিযানের বিশাল অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার। এসব ব্যবস্থা শুধু ‘সাপ্লাই’ কমাতে পারে। ‘ডিমান্ড’ থাকলে কোনো না কোনোভাবে সাপ্লাই হবেই। বাংলাদেশে মাদক আসক্ত মানুষের কোনো যথাযথ পরিসংখ্যান নেই। কেউ বলেন ৬০ লাখ, কেউ বা ৭০ লাখ। যদি একজন মাদকাসক্ত প্রতিদিন মাদকের পেছনে ৩০০ টাকা খরচ করেন, তাহলে প্রতিদিন আমাদের মাদকের পেছনে ন্যূনতম ব্যয় দৈনিক ১৮০ কোটি টাকা। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, প্রতিবছর ৭০ থেকে এক লাখ কোটি টাকার একটি অন্ধকার মাদক অর্থনীতি, যা আমাদের সর্বশেষ ঘোষিত বাজেটের পাঁচ ভাগের এক ভাগ। বিস্ময়কর ‘ডিমান্ড’ কমাতে হলে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন প্রয়োজন। মাদকের বিরুদ্ধে নাগরিক সচেতনতার ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন দরকার। মাদক দমনের ক্ষেত্রে কোনো শর্টকাট রুট আছে বলে এখন পর্যন্ত কারও জানা নেই। আমরা আমাদের অভিযানের পাশাপাশি দেশের মানুষকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেই। যেহেতু এটি একটি বেশ দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম এবং ব্যাপকতা বিশাল, তাই অভিযানের পাশাপাশি প্রাসঙ্গিক প্রস্তুতি নিয়ে আমরা ‘চল যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগান দিয়ে ১৪ মে ২০১৬ আনুষ্ঠানিকভাবে মিডিয়াকে ব্রিফ করার মাধ্যমে আমাদের অভিযানকে আরও তীব্রতর করি। আমরা আমাদের ব্রিফিংয়ে সব শ্রেণি-পেশা ও বয়সের নাগরিকদের সমর্থন চাই। মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবীদেরও আমরা অবৈধ পেশা ও নেশা হতে সরে আসার আহ্বান জানাই। গত দু’বছরের সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান মেলাতে বসি, তাহলে কী দেখতে পাব। একসময়ে মনে হতো, এ মাদকের সর্বনাশা ছোবল থেকে আমাদের সহসা পরিত্রাণ নেই। সেটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সময়োচিত সিদ্ধান্তে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর লাগাতার অভিযানে অমূলক প্রতিভাত হয়েছে। মানুষের মনে এখন বিশ্বাসের সঞ্চার হয়েছে যে আমরা এ ভয়াবহ আগ্রাসন থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি। প্রাথমিকভাবে আমাদের যে রকম মনে হয়েছিল, সমস্যার শিকড় তারও অনেক অনেক গভীরে প্রোথিত। অভিযানের সময় আমরা এমন অনেকেই এ ব্যবসায় জড়িত দেখেছি, যাদের সম্পর্কে গোয়েন্দা সংস্থা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা সাধারণ মানুষ কারোরই কোনো ধারণা ছিল না। কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা থেকে এমন কোনো পেশার লোক নেই, যেখান থেকে কেউ না কেউ এই অপকর্মে জড়িত নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ কেউ তাদের শপথ, পেশাগত নৈতিকতা ও গণমানুষের প্রত্যাশার প্রতি অবজ্ঞা করে এই অন্যায় অপরাধে লিপ্ত।
চলমান অভিযানের পাশাপাশি আমাদের এখনই সময় মাদকাসক্তের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন ত্বরান্বিত করা। এ ক্ষেত্রে মাদকাসক্ত নিজে, তার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের এগিয়ে আসতে হবে। আমরা সবকিছুতেই সরকারমুখী না হয়ে সরকারের সব উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি, বেসরকারি সংগঠন, এনজিও, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস ইউনিয়ন, চিকিৎসক, সমাজকর্মীদের এগিয়ে আসতে হবে। চলমান অভিযানের কারণে যেসব মাদক মামলা রেকর্ড করা হয়েছে, সেগুলোর দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত তদন্ত এবং ন্যায্যবিচার নিশ্চিত করা দরকার। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক বিশাল অন্তরায়। আমাদের আদালতগুলোয় ৩৫ লাখ মামলা বিচারাধীন। তার সঙ্গে প্রতিদিন নতুন করে হাজার হাজার মামলা যোগ হচ্ছে। আমরা মনে করি, যেসব মামলা বছরের পর বছর মুলতবি রয়েছে, এখন আর সাক্ষী আসে না, বিবদমান পক্ষগুলো বিভিন্ন কারণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে- সেগুলোর তুলনায় চলতি মামলার বিচারের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদান করলে কিছুটা হলেও সমাজে ইতিবাচক প্রতিফলন প্রক্ষেপিত হবে।
বাংলাদেশের মানুষ যখনই কোনো ন্যায় ও ন্যায্য কারণে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, ইতিহাস বলে প্রতিবারই তারা বিজয়ী হয়েছে। মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের সকলের চলমান যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার বিকল্প একটাই, সেটি হচ্ছে আমাদের এ যুদ্ধে বিজয়ী হতে হবে। আমাদের নবীনতম প্রজন্মের প্রতি আহ্বান- তোমাদের জন্ম এমন সময়, যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষার বিরুদ্ধে আমাদের প্রাথমিক বিজয় অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশ আজ আশপাশের অনেককেই টেক্কা দিয়ে উন্নত ও আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিকাশের পথে দ্রুতগতিতে ধাবমান। যৌবনের কবি হেলাল হাফিজকে উদ্ধৃত করে বলি- ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ তোমাদের পূর্বসূরিরা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে যৌবনের অমিত শক্তিতে দেশ স্বাধীন করে গেছেন। তোমাদের যৌবনের অদম্য তেজ ও শক্তিতে খুবই দ্রুত মাদক দানব চূড়ান্তভাবে পরাজিত হবে, এতে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : বেনজীর আহমেদ, মহাপরিচালক, র‌্যাব