উত্তম কুমার ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, কলকাতার আহিরীটোলায় জন্মগ্রহণ করেন । পরিবারের দেওয়া নাম ছিল অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। বাবা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় আর মা চপলা দেবী। অভাব-অনটনের সংসার; গিরিশ মুখোপাধ্যায় রোডের একটিমাত্র ঘরে তাঁরা থাকেন ৷ ভরসা বাড়িটি নিজেদের। বাবার সামান্য বেতনে সংসার চলছে না। উপায় না দেখে উপার্জনে নেমে পড়লেন বাড়ির বড় ছেলে অরুণ। পড়াশোনার পাশাপাশি গানের শিক্ষকতা শুরু করলেন। একসময় বেশ ভালো বেতনে গান শেখানোর লোভনীয় প্রস্তাব পেলেন, গাঙ্গুলী বাড়ির মেয়ে গৌরী দেবীকে। মাসে ৭৫ টাকা বেতন। গানের শিক্ষকতা করতে গিয়ে বেশ কাছাকাছি এলেন উত্তম-গৌরী। ১৯৫০ সালের ১ জুন, অরুণ কুমার বিয়ে করে ঘরে তোলেন গৌরী দেবীকে। ছোটবেলা থেকেই অরুণ কুমার, গানের পাশাপাশি প্রচন্ড থিয়েটার অনুরাগী ছিলেন, ছিলেন যাত্রাপালার ভক্ত। সে থেকেই সিনেমার পর্দায় অভিনয়ের ঝোঁকটা ক্রমেই বেড়ে চলল। ১৯৪৭ সালে হিন্দি চলচ্চিত্র ‘মায়াডোর’-এ অভিনয়ের সুযোগ মিলল ৷ মাত্র পাঁচ সিকিতে দৈনিক ভিত্তিতে ওই ছবিতে অভিনয় করলেন, এক্সট্রার রোল-এ। ‘মায়াডোর’ ছবিটি মুক্তি পেল না। ১৯৪৮ সালে আরেকটি সুযোগ পেলেন ‘দৃষ্টিদান’ ছবিতে নায়ক অসিত বরণের অল্প বয়সের চরিত্রে। কিন্তু দর্শকমনে তেমন দাগ কাটতে পারলেন না, অরুণ কুমার। পরের ছবি ‘কামনা’ ১৯৪৯ সালে মুক্তি পেল, সেটিও সুপার ফ্লপ। পরে আরো দুটি ছবি ‘মর্যাদা’-‘ওরে যাত্রী’ তাও ফ্লপ। ছবি ফ্লপ হচ্ছে, তারপরও দমে যাননি অরুণ কুমার। তখনও হাতে ছিল, ‘সহযাত্রী’ ও ‘নষ্টনীড়’ ছবি দুটি। মন-প্রাণ দিয়ে অভিনয় করলেও ফলাফল আগের মতোই। এতো ছবি ফ্লপ করার পরও তিনি সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন ৷ বিষয়টি ভালোভাবে নিল না অনেকেই। আড়ালে-আবডালে তাঁকে ডাকা শুরু হল এফএমজি (ফ্লপ মাস্টার জেনারেল) বলে। নামটা রটে গেলে সিনেমাপাড়ায়। পত্রিকার পাতায় এফএমজি ঘিরে খবরও ছাপা হল। অসফলতার ধারাবাহিকতার মধ্যেও, সরোজ মুখোপাধ্যায়ের ‘মর্যাদা’ ছবিতে নায়ক হিসেবে সুযোগ পেলেন। পরিচালকের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নাম পাল্টে হলেন ‘অরূপ কুমার’। ‘মর্যাদা’ ছবিটিও ভালো চলল না। একদিন ‘সহযাত্রী’ ছবিতে অভিনয় করছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা পাহাড়ি সান্যালের সঙ্গে। শুটিংয়ের ফাঁকে আড্ডায় পাহাড়ি সান্যাল হঠাৎ বলে উঠলেন- তুমি অরুণ নও হে, তুমি যে উত্তম, উত্তম কুমার। ব্যস.. তাঁর পরামর্শে নাম পাল্টে হয়ে গেলেন ‘উত্তম কুমার’। নাম বদলের প্রথম ছবি ‘সহযাত্রী’ও তেমন ব্যবসাসফল্য হলো না। ১৯৫১ সালে মুক্তি পেল ‘সঞ্জীবনী’ তাও ফ্লপ। নায়কের ভূমিকায় নয়, ছিলেন পার্শ্বচরিত্রে, ছবি ‘বসু পরিবার’। ছবিটি বেশ ভাল চলল, অভিনয়ের জন্য প্রথম প্রশংসিত হলেন উত্তম কুমার। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পেল নির্মল দের ছবি ‘সাড়ে-৭৪’। মুক্তির পর এই কমেডি ধাঁচের ছবিটি নিয়ে সবার কী উল্লাস। ছবিটি বক্স অফিস কাঁপিয়ে দিল ৷ টানা আট সপ্তাহ হলে চলল এই ছবিটি ৷ সাদা-কালো ছবি ‘সাড়ে ৭৪’-এর মাধ্যমে নতুন জুটির যে ইনিংসপত্তন হয়েছিল তাতেই রচিত হল বাংলা চলচ্চিত্রের রঙিন ইতিহাস। উত্তম কুমার পেলেন কালজয়ী সাফল্য, সৃষ্টি হলো বাংলা চলচ্চিত্রের এক নতুন যুগ। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয়ের আগ পর্যন্ত উত্তম কুমার, ছয় বছরে নয়টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। ছবিগুলোর ৯ নায়িকার মধ্যে আটজনই ছিলেন বয়সে তাঁর বড়। ছোট ছিলেন একমাত্র সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। মায়া মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে ছবি রায়, মনীষা দেবী, করবী গুপ্ত, ভারতী দেবী, সনিন্দা দেবী, সন্ধ্যা রানী ও মঞ্জু দে- আটজনকেই তিনি দিদি বলে ডাকতেন। অনেকেই মনে করেন, বয়সে বড় নায়িকাদের সঙ্গে অভিনয় করায় উত্তম কুমারের, শুরুর কেরিয়ারে প্রভাব ফেলেছে। ‘সাড়ে ৭৪’-এর জোয়ারের ঢেউ গিয়ে পড়ল পরের বছর। ১৯৫৪ সালে মুক্তি পেল উত্তম কুমার অভিনীত ১৪টি ছবি, তারমধ্যে সাতটিই ছিল সুচিত্রা সেনের সঙ্গে । ‘দৃষ্টিদান’ ছবি দিয়ে শুরু করে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ৩৩ বছরে বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে বহু ছবিতে অভিনয় করেছেন উত্তম কুমার। প্রথম ছবিতে মায়া মুখোপাধ্যায়, সর্বশেষ ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ ছবিতে মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়’সহ সর্বমোট ৪৬ জন নায়িকার বিপরীতে অভিনয় করেছেন উত্তম কুমার। ১৯৫৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, ‘সাড়ে-৭৪’ ছবির মাধ্যমে শুরু হওয়া উত্তম-সুচিত্রা জুটি ‘ওরা থাকে ওধারে’ ছবি দিয়ে পাকাপাকিভাবে দর্শক হৃদয়ে স্থান করে নেয়। তিপান্নর যাত্রা পঁচাত্তরে গিয় ‘প্রিয় বান্ধবী’ দিয়ে শেষ হয়। ২২ বছরে মুক্তি পেয়েছে উত্তম-সুচিত্রা জুটির সর্বমোট ৩১টি ছবি। অনাবিল হাসি, অকৃত্রিম চাহনি আর অভিনয় গুণে, তিন দশক ধরে সিনেমা দর্শকদের মোহাবিষ্ট করে পৌঁছে গেছেন জনপ্রিয়তার এক অনন্য উচ্চতায়। কয়েক প্রজন্ম পেরিয়ে আজও বাঙালির চেতনায় চিরদিনের মহানায়ক, উত্তম কুমার । আজ এই মহানায়ক-এর ৪৩তম প্রয়াণ দিবস। ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই, মাত্র ৫৪ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন। মহানায়ক উত্তম কুমার-এর প্রতি অন্তহীন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
আজাদ আবুল কাশেম