‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না’, ‘যার ছায়া পড়েছে মনের আয়নাতে’, ‘প্রাণ সখিরে ঐ শোন কদম্বতলে বংশী বাজায় কে’, ‘পদ্মার ঢেউরে’, ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের শিল্পী তিনি। তিনি দেশীয় সংগীতের পথিকৃৎ ফেরদৌসী রহমান।
সুদীর্ঘ সংগীত ক্যারিয়ারে পল্লীগীতি, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, ইসলামিক গান-গজল, আধুনিক ও চলচ্চিত্রসহ সব ঘরানার গানই প্রস্ফুটিত হয়েছে গুণী এই শিল্পীর কণ্ঠ।
এই শিল্পীর পিতা প্রখ্যাত লোকসংগীত শিল্পী আব্বাস উদ্দিন, যাঁর প্রতি শ্রোতাদের মুগ্ধতা অফুরান। সেই মুগ্ধতা ফেরদৌসী রহমানের ক্ষেত্রেও।
বাবা-ই তার প্রথম সংগীতগুরু। পরবর্তীতে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, ইউসুফ খান কোরেইশী, কাদের জামেরী, গুল মোহাম্মদ খান, নাজাকাত আলী খান ও সলামাত আলী খান প্রমুখ নামজাদা ওস্তাদদের কাছ থেকে গানের তালিম নেন তিনি।
রেডিওতে ‘খেলাঘর’ নামের একটা অনুষ্ঠানে যখন গান করেন, তখন বয়স ছিল মাত্র ৭ বছর, সেটা ১৯৪৮ সালের ঘটনা। তখন তিনি রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। এরপর ১৯৫৬ সালে প্রথমবারের মতো বড়দের অনুষ্ঠানে গান করেন। ১৯৫৭ সালে প্রথম গান রেকর্ড করেন এইচএমভি করাচি থেকে। এখানেই শেষ নয়, খুব অল্প বয়সেই তাঁর আরো উল্লেখ করার মতো অর্জন রয়েছে। সিনেমায় প্রথম প্লে-ব্যাক করার সময় তাঁর বয়স ১৮।
‘আসিয়া’ নামে চলচ্চিত্রে তিনি প্লে-ব্যাক করেন ১৯৫৯ সালে, আর তা মুক্তি পায় ১৯৬০-এ। এ চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিলেন ফতেহ লোহানী। এই ছবি মুক্তির আগে অবশ্য মুক্তি পায় ‘এ দেশ তোমার আমার’ ছবিটি, যেখানে তিনি গান করেন। ফলে এটাকেই তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র বলা যায়।
প্রথম প্লে-ব্যাক গাওয়ার এক বছর পর আরো একটি বিশেষ যোগ্যতা দেখান তিনি। ১৯৬০ সালে রবীন ঘোষের সঙ্গে সংগীত পরিচালনা করেন ‘রাজধানীর বুকে’ নামক চলচ্চিত্রে। এর মাধ্যমে তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম নারী সংগীতপরিচালক হিসেবে অভিষিক্ত হন।
’৬০ ও ’৭০-এর দশকের অনেক চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন ফেরদৌসী রহমান। তাঁর চলচ্চিত্রে গাওয়া গানের পরিমাণ ২৫০-এর অধিক। বাংলা ছাড়াও উর্দু, ফার্সি, আরবি, চীনা, রুশ, জার্মানসহ আরো কিছু ভাষায় গান গেয়েছেন। ২০টির মতো অ্যালবাম রয়েছে ফেরদৌসী রহমানের। তাঁর রেকর্ডকৃত গানের পরিমাণ ৫ হাজারের অধিক।
ফেরদৌসী রহমান কৃতী ছাত্রী ছিলেন। পড়তেন সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স কনভেন্ট স্কুলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে গ্রাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে সংগীতে ইউনেস্কো থেকে একটি ফেলোশিপ পান। এই ফেলোশিপে ছয় মাসের কোর্সে ট্রিনিটি কলেজ অব মিউজিক লন্ডনে পড়তে যান।
সারাজীবন শ্রোতাদের মুগ্ধ করে গেছেন ফেরদৌসী রহমান। এই মুগ্ধতা বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তাঁকে গান শোনাতে হয়েছে বহু দেশে ঘুরে। এর মধ্যে রয়েছে ভারত, ইরাক, সিঙ্গাপুর, চীন, জাপান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুগোস্লাভিয়া, যুক্তরাজ্যসহ আরো অনেক দেশ।
শ্রোতাদের ভালোবাসা তো তিনি চিরকালই পেয়েছেন, একই সঙ্গে পেয়েছেন অগণিত প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি-পুরস্কার। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রধান সব পুরস্কারই তাঁর ঝুড়িতে রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য— স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, শ্রেষ্ঠ টিভি শিল্পী জাতীয় সম্মাননা, সেরা সংগীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক পুরস্কার, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কারসহ আরো অসংখ্য পুরস্কার।
ফেরদৌসী রহমান ১৯৪১ সালের ২৮ জুন পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে জন্মগ্রহণ করেন।
গোপাল দেবনাথ, কলকাতা