জন্মদিনে স্মরণঃ ম ধু বা লা

বলিউডে সৌন্দর্যের প্রসঙ্গ উঠলেই প্রথম সারিতে উঠে আসে তার নাম। সাদা-কালো পর্দাতেও ঝলসে উঠত তার চোখের চাহনি। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখতেন দর্শকরা। আজ আর সেই ‘মুঘল-ই-আজম’-এর জমানা নেই। কিন্তু রয়ে গিয়েছে মধুবালার সেই মুগ্ধতা। যা আজও মানুষের মনে থেকে গিয়েছে।
হৃদপিণ্ডে ছিদ্র নিয়ে জন্মানো মধুবালার হৃদয় হয়েছিল ফুটো থেকে ছিন্ন-ভিন্ন-রক্তাক্ত। প্রেমিকের হাত ধরে ঘর ছাড়ার বাসনাতেও প্রেমিক করেনি বরণ বরং ছিটকে ফেলেছে অনাদরে। প্রেমিকার মন কী করে সয়! অভিমানে আরেক পুরুষের ঘরোনি! তাতে সুখ আসে কি হৃদয়ে? যাতনার পীড়ন বাড়ে হাড়ে হাড়ে। মধুবালা সে পীড়নে লাইট সাউন্ড অ্যাকশন আর রংকরা পোশাক-ডায়লগ-এর আড়ালে পুড়তে থাকে সব চোখের অগোচরে।
পারিবারিক নাম মমতাজ জাহান দেহলভী হলেও অভিনয় জীবনে প্রবেশের ক্ষণকাল পরে আরেক অভিনেত্রী দেবিকা রানী তার নাম রাখেন ‘মধুবালা’। বলিউডের এই সুন্দরী মেধাবী তৎসময়ে সাড়াজাগানো নায়িকা পরবর্তীতে ‘মধুবালা’ নামেই বলিউডে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
দিল্লির এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে আতাউল্লা খান এবং বেগম আয়শার ঘরে ৪০-৫০ এর দশকে সাড়া জাগানো নায়িকা মধুবালার জন্ম। এগারো ভাই-বোনের মধ্যে পঞ্চম মধুবালা বড় হবার আগেই তার দুই ভাই-তিন বোন মারা গেলে তার পরিবার এক অসহায়ত্বের মধ্যে পড়ে।
পাকিস্তানের পেশোয়ায় এক টোব্যাকো কোম্পানিতে চাকরি করতেন আতাউল্লা। হটাৎ করে সে চাকরি চলে যায়। ফলে পরিবারটি এক নিরূপায় কূপে পতিত হয় এবং জীবনের স্রোতস্বিনী টানে দিল্লি ছেড়ে বোম্বাই (বর্তমান মুম্বাই) নগরে চলে আসেন জীবিকার খোঁজে।
একদিকে সংসারে অভাব-অনটন অন্যদিকে ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে; আতাউল্লা পথ পেলেও পথের দিশা পান না। শত অভাব থাকলেও পরিবারটির ছিল শিল্প-সংস্কৃতির দিকে যত্নের খেয়াল। একটু-আধটু চর্চাও হতো সময়ে অসময়ে। চেনাজানাও ছিল এ মাধ্যমের মানুষদের সাথে। অভাব যখন ঘাড় ছেড়ে মাথার উপর বাসা বাঁধে তখন একদিন আতাউল্লার কাছে ডাক আসে তার মেয়েকে শিশু শিল্পী হিসেবে অভিনয় করতে দেয়ার। তখন মধুবালার বয়স সবেমাত্র নয় বছর।
সংস্কৃতির দিকে টান আবার অভাবের সংসারে যদি কিছু টাকা আসে! এই ভেবে সম্মতি ও নয় বছর বয়সে শিশুশিল্পী হিসেবে মধুবালার প্রথম অভিনয়। জাত চেনা যায় আঁশ দেখেও। শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করলেও তার ভিতরে জাত অভিনেত্রীর বীজ আছে, টের পেয়েছিলেন বলিউডের অনেক চলচ্চিত্রনির্মাতা।
মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে ‘নীল কমল’ (১৯৪৭) সিনেমায় প্রধান অভিনেত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। রাজ কাপুরের বিপরীতে অভিনয় করা এ সিনেমাই সর্বশেষ সিনেমা যেখানে তিনি ‘মধুবালা’ নয় ‘মমতাজ’ নামে পর্দায় হাজির হয়েছিলেন। এরপর ‘মধুবালা’র বড় পর্দায় আগমন আর পরবর্তী দু’বছরের গল্প শুধু এগিয়ে চলার। তার রূপের জাদুতে রূপালি পর্দাকে মোহাবিষ্ট করার।
এরপর ১৯৪৯ সালের ‘মহল’ সিনেমার মাধ্যমে বলা যায় রাতারাতিই তিনি মহাতারকা বনে যান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ অবলম্বনে নির্মিত ‘মহল’ সিনেমাটির বিপুল সাফল্য তার ক্যারিয়ারে অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট হয়ে উঠে। এরপর মধুবালার জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়তেই থাকে। একে একে মুক্তি পায় ‘দুলারি’(১৯৪৯), ‘বেকসুর’(১৯৫০), ‘তারানা’(১৯৫১), ‘বাদল’(১৯৫১) সহ অন্যান্য ছবি।
সবকটি সিনেমাই ছিল বাণিজ্যিকভাবে সফল। মধুবালার তারকা-খ্যাতি ভারত পেরিয়ে সাড়া ফেলে হলিউডেও।
১৯৫২ সালের আমেরিকান ম্যাগাজিন ‘থিয়েটার আর্টস’ এ তাকে নিয়ে ‘The Biggest Star in the World– and she’s not in Beverly Hills’-শিরোনামে একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়। এছাড়া একাডেমী এ্যাওয়ার্ড বিজয়ী আমেরিকান পরিচালক ফ্রাঙ্ক ক্যাপরা তাকে অভিনয়ও করতে চেয়েছিলেন হলিউডে। কিন্তু তার বাবা রাজি না হওয়ায় সে আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেন তিনি। ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯ সালে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মধুবালা মৃত্যুবরণ করেন।
গোপাল দেবনাথ, কলকাতা