জাদুমাখা কন্ঠ দিয়ে দশক’র পর দশক ধরে মাতিয়ে চলেছেন লতা মঙ্গেশকর

জাদুমাখা কণ্ঠ দিয়ে দশকের পর দশক ধরে শ্রোতাদের মাতিয়ে চলেছেন লতা মঙ্গেশকর। এখনো তিনি আগের মতো জনপ্রিয়। আরও অনেক অনেক বছর থাকবেন— তা হিসেব-নিকেশ ছাড়াই বলা যায়।
মারাঠী গানের মাধ্যমে ১৯৪২ সালে লতার সঙ্গীত ক্যারিয়ার শুরু। হিন্দি সিনেমায় তার প্রথম গান করেন ১৯৪৬ সালে। বসন্ত যুগলকরের ‘আপ কি সেবা ম্যায়’ সিনেমায় তার গাওয়া ‘পা লাগো কর জুরি’ গানটি ব্যবহৃত হয়। দুই বছর পর ‘দিল মেরা থোরা’ গানের মাধ্যমে মুম্বাইয়ে পায়ের নিচে শক্ত ভিত্তি পান। গুলাম হায়দারে সঙ্গীত আয়োজনে গানটি ব্যবহৃত হয় ‘মজবুর’ চলচ্চিত্রে। এর পর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। অচিরেই জুটে যায় ‘নাইটিঙ্গেল অব ইন্ডিয়া’ উপাধি। নিজের সময়ের সব নামকরা সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন লতা। বর্তমান সময়ের অনেক সঙ্গীত পরিচালকের সেরা গানটিও গেয়েছেন তিনি। রোমান্টিক থেকে ভজন— যে কোনো ধারার গানে লতা সমান পারদর্শী। এক কথায় বলা যায়, হিন্দি সিনেমার গানের ব্যবচ্ছেদ করতে গেলে লতা অপরিহার্য।
লতার নাম প্রথমে ছিল হেমা। পরে সে নাম পাল্টে দেন বাবা দীননাথ। নিজের লেখা নাটকের চরিত্র লতিকা থেকে নামটি বেছে নেন তিনি। লতা পরিবারের সবচেয়ে বড় সন্তান। তার অন্য ভাই-বোন হলেন মিনা, আশা, ঊষা ও হৃদয়নাথ।
তার পরিবারের শেষ নাম ছিল হরদিকর। কিন্তু বাবা দীননাথের সময়ে এসে তা পরিবর্তিত হয় মঙ্গেশকরে। লতার বোন আশা ভোঁসলেও নামকরা গায়িকা। গিনেস বুকে আশার নাম লেখা আছে। কারণ তিনি সবচেয়ে বেশি গান রেকর্ড করা শিল্পী। এর আগে রেকর্ডটি ছিল লতার।
লতা মঙ্গেশকর ও মোহাম্মদ রফির অনেক স্মরণীয় দ্বৈত গান রয়েছে। তবে তাদের সম্পর্ক সবসময় মসৃণ ছিল না। গানের স্বত্ব নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। এর পর অনেকদিন একসঙ্গে গান করেননি। লতা জানান, রফি লিখিতভাবে ক্ষমা চাইলে দূরত্বের অবসান ঘটে। তবে রফির ছেলে শহীদ রফি এ বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করেন।
সঙ্গীত পরিচালক নওশাদ ও লতার জুটি ছিল জাদুকরি। তারা একসঙ্গে কাজ করেন ‘বৈজু বাওরা’ (৫২), কোহিনূর (৬০) ও ‘মুঘল-ই-আজম’ (৬০)-সহ অনেক বিখ্যাত চলচ্চিত্রে। এর মধ্যে ‘মুঘল-ই-আজম’র ‘পেয়ার কিয়া তো ডারনা কিয়া’ কাল্ট স্ট্যাটাস পাওয়া গান।
কিশোর কুমারের সঙ্গে লতার সবচেয়ে জনপ্রিয় গান ‘গাতা রাহে মেরা দিল’। গানটি বিখ্যাত ‘গাইড’ (৬৫) সিনেমায় ব্যবহৃত হয়।
১৯৯৯ সালে তাকে রাজ্য সভার সদস্য হিসেবে মনোনীত করা হয়। তবে অসুস্থতার জন্য অধিবেশনে খুব কমই দেখা গেছে লতাকে।
আঞ্চলিক ও বিদেশী মিলিয়ে তিনি ৩৬টির বেশি ভাষার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। তবে এর বেশির ভাগ ভাষাই তিনি বুঝতে পারতেন না। যেমন— বাংলা।
হিন্দিতে লতা প্রথমবার প্লেব্যাক রেকর্ড করেন ১৯৪৩ সালে। মারাঠী সিনেমা ‘গাজাবাউ’-এ ব্যবহৃত গানটির শিরোনাম হল ‘মাতা এক সাপুত’। ‘মহল’ (৪৯) সিনেমায় লতার গাওয়া ‘অ্যায়েগা আনেওয়ালা’ গানে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন মধুবালা। গানটি ছিল লতার প্রথম বড় ধরনের হিট। ১৯৭০ এর দশকজুড়ে একের পর এক হিট গান উপহার দিয়েছেন রাহুলদেব বর্মণ ও লতা মঙ্গেশকর। তাদের জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে : ‘অমর প্রেম’ (৭২) সিনেমার ‘রায়না বেটি জায়ে’, ‘কারাভান’ চলচ্চিত্রের ‘চাদি জাওয়ানি’ ও ‘কিতনা পেয়ারা ওয়াদা হ্যায়’, ‘কটি পাতাং’ (৭১) এর ‘আজ না ছোড়েয়েঙ্গে’ এবং ‘আন্ধি’ (৭৫)-সহ অনেক সিনেমার স্মরণীয় গান।
লতা সবচেয়ে বেশি প্লেব্যাক করেছেন লক্ষীকান্ত- পেয়ারলালের সঙ্গীত পরিচালনায়। এ সংখ্যা ৭১২। এ ছাড়া— শংকর জয়কৃষাণ (৪৫৩), আর ডি বর্মণ (৩২৭), সি রামচন্দ্র (২৯৮), মদন মোহন (২১০), এস ডি বর্মণ (১৮২), নওশাদ (১৫৫)-সহ অনেক বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালকের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন।
“আনন্দ গম” ছদ্মনামে ৫টি মারাঠী সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনা করেন লতা মঙ্গেশকর। এর মধ্যে ‘সাদী মনসে’ সিনেমার জন্য মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকারের দেওয়া সেরা সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কার জেতেন। একই সিনেমার একটি গান পায় সেরা গানের পুরস্কার। তিনি মারাঠী ও হিন্দি মিলিয়ে ৪টি সিনেমা প্রযোজনা করেন।
গত একযুগে প্লেব্যাকে লতা মঙ্গেশকরকে তেমন একটা পাওয়া যায় না। ২০১৫ সালে তিনটি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। এর মধ্যে দুটিতে তার সঙ্গে ছিলেন কুমার শানু। লতা মঙ্গেশকর ১৯২৯ সালের আজকের দিনে ব্রিটিশ ভারতের ইন্দোর রাজ্যের শিখ মহল্লায় জন্মগ্রহণ করেন।
গোপাল দেবনাথ, কলকাতা