ষাটের দশকে অত্যন্ত জনপ্রিয় সিনেমার নায়ক ছিলেন সরকার কবীর উদ্দিন। তাঁর অভিনীত তিনটি ছায়াছবি ইতিহাসে উজ্জল হয়ে আছে। নতুন নামে ডাকো , নতুন ফুলের গন্ধ ও মায়ার সংসার, এই ছায়াছবিগুলো অনেকেরই স্মৃতিতে অম্লান। সরকার কবীর উদ্দিন ভাইয়ের সাথে যথাক্রমে নায়িকা ছিলেন সুচন্দা, কবরী ও সুজাতা।
বাংলা সিনেমার অন্যতম কিংবদন্তী নায়িকা কবরীর সাম্প্রতিক প্রয়ান সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে আসে।মিস্টি কবরী যেন সবার হৃদয়ে অবস্থান। তাঁর শোকের জন্য সোস্যাল মিডিয়া সয়লাব হয়ে যায়।কবরী ও সরকার কবীর নতুন ফুলের গন্ধ ছায়াছবিতে অভিনয় করেন।কবীর ভাই কয়েক যুগ আগে সিনেমা জগত ছেড়ে দিলেও অনেকের কথা মনে আছে। এখন তিনি এখন বেতার ও টিভি জগতে অন্যতম কিংবদন্তী, ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের ম্যানেজিং এডিটর।কবরীর চলে যাওয়া তাঁর হৃদয় ভারাক্রান্ত। কবীর ভাইয়ের সাথে কথা হলো কবরীকে নিয়ে।
শুরুতেই সরকার কবীর বলেন, কবরী আমার সাথে অভিনয় করেননি , আমি তাঁর সাথে অভিনয় করার সুযোগ পেরেছিলাম । ষাটের দশকে আমি যখন করাচীতে ছিলাম , তখন বেতার ও টিভিতে কাজ করতাম এবং পিআই এ ভাষা প্রশিক্ষকের কাজ করতাম। তখন সিনেমা জগতের একটি গ্রুপ আমাকে প্রস্তাব দেন একটি ‘রাজকুমারী’ নামে ছায়াছবিতে অভিনয় করতে। তাঁরা বলেন, কবরী চৌধুরী নায়ক হবেন এবং আপনি হবেন নায়ক। আমি তাঁর প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছিলাম।অবশ্য বিভিন্ন কারনে তাঁরা আর সেটি করতে পারেননি।তখনো কবরী লাইমলাইটে আসেননি। পরবর্তীতে তিনি নায়িকা হিসেবে সফল ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
৬৫ সালের দিকে আবার আমন্ত্রন পান সরকার কবীর। তিনি বলেন, আমার প্রথম ছবি ছিলো ‘নতুন নামে ডাকো।মমতাজ আলীর ছবিতে সুপারভাইজারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন জহির রায়হান। তখন নায়িকা ছিলেন সুচন্দা।তখন ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা। সেখান থেকে আমার যাত্রা শুরু। ইতিমধ্যে অত্যন্ত ও সুপ্রতিস্ঠিত হয়ে গেছেন কবরী। মমতাজ আলী ছিলেন আমার প্রথম ছাছবির পরিচালক ও প্রযোজক। আমার দ্বিতীয় ছবিতে নায়িকা ছিলেন কবরী।আমি যেন আবার সুযোগ পেলাম রাজকন্যার মতো অভিনয় করতে। নতুন ফুলের গন্ধ ছবিতে কবরীর সাথে আমার সুযোগ হয়। তখনকার পাকিস্তানের অন্যতম জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী আহমেদ রুশদী এই ছবিতে গাইলেন।’ কে তুমি এলেগো আমারই এই জীবনে’।
কবরী চৌধুরী আমার জীবনে অনেক পুরুষ ও নারী এসেছেন কিন্তু তিনি যেন অসাধারন স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ব । তিনি সবসময় হাসতেন, মিস্টি করে কথা বলতেন। তিনি কখনোই কারও প্রতি নারাজ হতেন কিংবা উস্মা প্রকাশ করতেননা। এমন কোন মুহুর্ত দেখেনি অন্যরকম মুডে। এই ছায়াছবির শুটিং এর সময় কতো চমৎকার কেটেছে।মতিঝিলে যখন একটি পুলিশ হাসপাতাল ছিলো এবং সেখানে চিত্রায়ন হয়। কাহিনীতে ছিলো দৃশ্যে ছিলো অন্তর্ংগতা। আমি কোনভাবেই জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারছিলামনা। তখন বলেন , আমি ও আপনি এই দৃশ্যে ভালোবাসার সিকোয়েন্স। তাই এতে অনন্তরংগ হরে হয়। আপনি সহজ হোন, আমি আপনাকে সহজ তরে দেবে। সহ অভিনেতার প্রতি তাঁর ছিলো অসাধারন মমত্ববোধ।কবরীর মতো এমন একটি মিস্টি মেয়ে যা তুলনাহীন।
পরবর্তীকাল কবরীর সাথে আমার যোগাযোগ ছিলো। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে কথা হতো। আমার জীবনে তিনি ছিলেন সত্যিই একজন অসাধারন। মিস্টি বললেও কম বলা হয়। তাঁকে একজন পুর্নাংগ নারী হিসেবে । তাঁর আত্মার মংগল কামনা করি, শান্তি কামনা করি। তিনি যেখানেই থাকবেন তিনি যেন ভালো থাকেন।বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ তাঁকে পছন্দ করেছেন, ভালোবসতেন।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর আমি যখন পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আফগানিস্তান, দিল্লী ও কোলকাতা হয়ে আসছিলাম। হঠাৎ দেখি কোলকাতার দেয়ালে একটি সিনেমার পোস্টার। কবরীর ছবির পাশে দেখা যায় আমার মতো দেখতে একজনকে ! এটি ছিলো নতুন ফুলের গন্ধ ছায়াছবির একটি প্রচারপত্র। সেটাই ছিলো কোলকাতার মেট্রোতে প্রথম প্রদর্শন। সেখানে সবসময় ইংরেজী ছবি দেখানো হতো। প্রথম নন-ইংলিশ এবং বাংলাদেশী ফিল্ম ছিলো মেট্রোত্।,তখনতো ওখানকার লোকজন আমাকে চিনতেননা কিন্তু কবরীকে চিনতেন। তখন বাংলাদেশ ও ভারতের সাথে ঘনিস্ঠ সম্পর্ক ছিলো। পরবর্তীতে এই মুভিটির কোন কপি পাওয়ার জন্য আমি অনেক চেস্টা করেছি। এমনকি আর্কাইভেও পাওয়া যায়নি। পরিচালক মমতাজ আলী অনেক আগেই প্রয়াত হয়েছেন কিন্তু পরিবারের সাথে যোগাযোগ হলে কোন হদিশ মেলেনি। পরবর্তীকালে কবরীর সাথে আমার কয়েকবার যোগাযোগ হয়েছে। তাঁর ছেলে বসবাস করেন ওয়াশিংটন এলাকায়। তিনি বেশ ক’বার এসেছেন । আমার সাথে যোগাযোগ হয়েছে এবং ভয়েস অব আমেরিকায় এসেছেন।
বাংলাদেশের কোটি কোটি কবরীর ভক্তদের সাথে আমিও নগন্য হিসেবে তাঁকে কোনদিন ভুলবোনা। কবীর ভাই অত্যন্ত ইমোশনাল হয়ে বলছিলেন।বলছিলেন , তখন আরেকজন নায়িকা ছিলেন। সহ নায়িকা ছিলেন আনোয়ারা। দৃশ্যে এমন ছিলো, আনোয়ারার লাশ নিয়ে আমি তুলে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।তখন সূর্য় ডুবছে। লোকেশন ছিলো কারওয়ান বাজার। তখন আমি ছিলাম বেশ হাল্কা পাতলা। আনোয়ারা বেশ ভালোই বেশ স্বাস্থবান ছিলেন।আমি লাশ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি সূর্য ডোবার দিকে কিন্তু পরিচালক মমতাজ আলী কাট করছিলেননা। এদিকে আমার হাত যেন অবশ হয়ে যাচ্ছিলো। সাইলেন্ট দৃশ্য ছিলো। অবশেষে বললাম , মমতাজ ভাই প্লিজ কাট।
শুটিং শিডিউল পাঠাতেন পরিচালক। আমি করাচী থেকে ঢাকা বিমান বন্দরে নেমে সরাসরি চলে যেতাম এফডিসিতে। দু’তিন শুটিং হতো, থাকতাম শেরাটন হোটেলে এবং বাবার বাসায় থাকতাম। নতুন ফুলের গন্ধ নিয়ে অনেক স্মৃতি রয়েছে। কবরী ও বর চিত্ত চৌধুরীর বাসা ছিলো ফার্মগেটের পাশে একটি বাংলো। শুটিং শেষে ওদের বাসায় গিয়ে আড্ডা দিতাম। কবরী ও আমার অত্যন্ত ঘনিস্ঠ প্রখ্যাত সাংবাদিক লেখক আজাচৌ ( আহমেদ জামান চৌধুরী) একসাথে সময় কাটতো। কবরী নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতেন। যাতে থাকতো স্পেশাল আইটেম শুটকি। আমার খুব ফেভারিট ছিলো শুটকি। এখন আর শুটকি খেতে পারিনা। কারন কবরীকে খুব মনে পড়ে। সেই বাসাটা আর কোথায় কিভাবে আছে আমার কোন জানা নেই।
সরকার কবীর ভাই বললেন, আপনিতো জানেন কবরী একজন সাংসদ ছিলেন। হঠাৎ স্মৃতিতে এলো, রাহাত খানের ৫০তম জন্মদিন উপলক্ষে জাতীয় যাদুঘর মিলনায়তনে একটি জমজমাট আয়োজিত হয়। তখন ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল এবং কবরী সেই অনুস্ঠান উপস্থাপন করেছিলেন। হেনা ভাইয়ের সাথে গভীর বন্ধুত্ব ছিলো কবীর ভাইয়ের। সবশেষে জানালেন, কবরীর প্রতি আমার বিনীত শ্রদ্ধা নিবেদন তাঁকে কোনদিন ভুলবোনা ।
আকবর হায়দার কিরন, নিউইয়র্ক