করোনার ডায়েরি

কেন আশা বেঁধে রাখি, নিজেকেই প্রশ্ন করি। শোবার ঘরের জানালা দিয়ে দেখি দৃষ্টিতে নিরেট বাধা সমকোনে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো দালান। দুটোর মাঝখান দিয়ে একটা গাছ দেখা যায়। ওটার মাথায় এক চিলতে আকাশ, যেন আশার ঝিলিক। আজ কি তাহলে কোন ভালো খবর পাবো!
আমার মত ঘরকুনোকে জার্মানীর ব্ল্যাক ফরেস্ট দেখানোর আশা দিয়েছিল মনি। দক্ষিণ পশ্চিম জার্মানীতে রাইনের উপত্যকায় পাহাড়ী বন। ফেল্ডবার্গ চুড়া সর্বোচ্চ, উচ্চতা ৪ হাজার ৮৯৮ ফুট। না, যাইনি সেখানে। ইংরেজিতে যাকে বলে আর্মচেয়ার টুরিস্ট, আমি তাই। কেন যেন মনে হয় দেখার কোন কিছু দেখে ফেললে সে আর মনের ভিতরে আরাধ্য রমনী হয়ে থাকেনা। পাঘীর (প্যারিস) লুভ যাদুঘরে ডা ভিঞ্চির লা জোকন্ডা (মোনা লিসা) দেখেও তাই মনে হয়েছিল, কেন দেখে ফেললাম।
বাংলাদেশের সাংবাদিক মনোয়ারা বেগম মনি ৩০ বছর ধরে জার্মানীতে প্রবাসী। মনির বন্ধুরা জানেন মনের সব নিরাশার মেঘ কাটিয়ে উচ্ছলতা বইয়ে দেয়ার যাদু ও জানে। লন্ডনে চলে আসার আগে আমরা জনা বিশেক সাংবাদিক আর উন্নয়ন কর্মী কুমিল্লার বার্ডে তিনদিনের এক ওয়ার্কশপে গিয়েছিলাম। ফিরে আসার আগের রাতে রাতভর আড্ডা, মনি মধ্যমনি হয়েই ছিল। আর ছিল ইকবাল, অদ্ভুত তার গানের গলা, এখনো কানে লেগে আছে। মনির সঙ্গে এই বিনে পয়সার ফোনের যুগে ঈদে পার্বনে বছরে দু’বছরে কথা হয় ফোনে। কোনবারেই একঘন্টার কম নয়, প্রতিবারেই মনে হয় যেন আমরা প্রতিদিনই কথা বলছি।
মনির মনটা ভালো নেই। গতমাসের প্রথম দিকে ও মাকে হারিয়েছে। তাই দু’দিন ফোন করে পাইনি। ও পরে ফোন করে জানালো খবরটা। মনি বললো মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে ঢাকায় গিয়েছে। শেষবারের মত দেখেছিল মায়ের মুখ। তাঁর দাফনেও কোন অসুবিধা হয়নি। কিন্তু মিলাদের দিনে আত্মীয় বন্ধুদের কেউ কেউ আসেননি, ও জার্মানী থেকে গিয়েছে তাই। এখন আটকা পড়ে গিয়েছে ঢাকায়। মনি বললো, মেয়েদের হাতব্যাগের মত মৃত্যুকে হাতে ঝুলিয়ে বেঁচে আছি। এমন দুঃসময়েও হাসির কথা ও হারায় না।
কি আশা করতে পারি, আশা করতে না পারলেও কামনা করবোই, বাংলাদেশে যেন আর একজনেরও করোনায় মৃত্যু না হয় আর মনি যেন ভালভাবে ফিরে আসে সন্তানদের কাছে।
বাজার করতে যেতে হয়েছিল আজ। সকাল থেকে চেষ্টা করে জানতে পেলাম সেইন্সবেরি থেকে সংগ্রহ করারও সময় খালি নেই। কাছের দোকানে গেলাম। কান্তা যেয়ে বাজার করে আনলো। আমি গাড়িতেই বসা ছিলাম। পুরুষের প্রাধান্য নয়, তাঁরই নির্দেশ। আমি মানছি, কিন্তু করোনার কারণে এদেশে গৃহে সহিংসতার ঘটনা অত্যন্ত বেড়ে গেছে।
আজ মৃতের সংখ্যা বাড়লেও একটু আশার আলো দেখছি। গতকাল সোমবার মৃতের সংখ্যা অনেক কম হওয়ার এক কারণ শনি রবিবারের ছুটিতে উপাত্ত পাওয়া যায় কম। আগের কয়েক সপ্তাহেও একই প্রবনতা দেখা গিয়েছে। সেই হিসেবে আজ মৃতের সংখ্যা বাড়লেও তাতে গত কয়েকদিনের মৃতের সংখ্যাও রয়েছে। পাকা যে সংখ্যা পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায় সে হিসেবে চলমান গড় পড়তির দিকে। কাজেই বলা যায় বৃটেন প্রথম চুড়ান্ত অবস্থা পার করছে। খাদে কোথায় থামে সেটাই দেখার অপেক্ষা। এই প্রবনতা থাকলে সপ্তাহের শেষের দিকে ভাল খবর পাওয়া যেতে পারে। উপ-প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা অধ্যাপক জনাথন ভ্যান ট্যাম সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, হাসপাতালগুলোয় করোনা রোগী ভর্তির সংখ্যা কমে আসছে। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ভর্তি হয়েছিল ১০ এপ্রিল। তারপর থেকেই এই সংখ্যা কমতে শুরু করে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের গবেষকরা করোনা (কোভিড ১৯) ভাইরাসের একটি প্রতিষেধক মানবদেহে পরীক্ষা শুরু করবেন বৃষ্পতিবার থেকে।
সরকারী হিসাবে বৃটেনের হাসপাতালগুলোয় আজ মৃতের সংখ্যা গতকালের চেয়ে ৮২৩ বেড়ে, মোট মৃত ১৭ হাজার ৩৩৭। পরীক্ষিতদের মধ্যে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ৩৭৫ কমেছে। আজ আক্রান্ত ৪ হাজার ৩০১, মোট আক্রান্ত ১ লাখ ২৯ হাজার ৪৪। বার্মিংহামে আক্রান্তের সংখ্যা ৫১ জন বেড়ে ২ হাজার ৩৬১।
জাতীয় পরিসংখ্যান কার্যালয় থেকে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস প্রদেশে করোনায় মৃতের একটা মোটামুটি পাকা হিসাব দেয়া হয়েছে। তাতে দেখা যায় ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত হাসপাতালে মৃতের সংখ্যা বলা হয়েছিল ৮ হাজার ৯৩৭। কিন্তু সব মৃতের সংখ্যা মিলিয়ে দেখা যায় ঐদিন পর্যন্ত করোনায় মৃতের আসল সংখ্যা ৩ হাজার ৫৭৯ জন বেশি, ১২ হাজার ৫১৬।
সন্ধ্যায় শুনলাম লাকী আখন্দের গান –
আবার এলো যে সন্ধ্যা
শুধু দুজনে,
চলো না ঘুরে আসি –
আজ লাকী আখন্দের মৃত্যু বার্ষিকী।

কাজী জাওয়াদ
বার্মিংহাম, যুক্তরাজ্য
উল্লেখ্য: লেখক এর অনুমতি নিয়ে প্রকাশকরা হলো।