৫ জানুয়ারি বাবা মারা যাওয়ার দিন সকালেও বাড়ির ইস্ট দেবতার জন্যে নিজ হাতে ছাদ বাগানের ফুল তুলেছেন। খুব সকালে উঠে হাঁটাহাঁটির পর স্নান সেরে আমাদের চারতলা ও দোতলার ছাদ বাগানের ফুল গাছ থেকে ফুল তোলা তার নৈমত্তিক কাজ ছিল। শীত গ্রীষ্ম ঝড় বৃষ্টি তাকে থামাতে পারতো না। তিনি প্রতিদিনই ফুল তুলে এনে আমার অসুস্থ্য মাকে দেখাতেন। একটি বিশেষ ফুল গাছ ছাদ বাগানে না থাকায় তিনি মার কাছে আফসোস করতেন। আমাকে প্রায়ই বলতেন ওই ফুলের একটা চারা গাছ ছাদ বাগানে লাগাতে। আমি অনেক বার সেই গাছের চারা খুঁজেছি। কিন্তু পাইনি।
ওই ফুল গাছ ছাদ বাগানে লাগিয়ে দেওয়ার জন্যে কেন তার আবদার, সেটাও জানতাম। আজ থেকে বছর দশক আগে, তখন আমার আমার বাড়িতে বিল্ডিং হয়নি। ছাদ বাগান তো থাকার প্রশ্নই ওঠে না। আমাদের বাজারের পাশেই একটি গ্রাম থেকে তিনি ফুল তুলে আনতেন। বাড়িতে তখন বলতেন, আমাদের বিল্ডিং হলে অবশ্যই যেনো ছাদ বাগান করি। তো, একবার হলো কী ? তিনি লক্ষ্মী পূজার ফুল আনতে গিয়ে একজনের কাছে তার গাছের একটি ফুল চেয়েছিলেন। ওই লোকটি বাবার পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও দেননি।
বসন্ত ও শরৎ কালে ফোটা ওই ফুলের প্রতি বাবার খুব ভালো লাগা ছিল। বিশেষ করে প্রতিবছর লক্ষ্মীপূজার সময় ওই ফুল সংগ্রহের জন্যে তিনি আকুল থাকতেন। তো, বিল্ডিং হওয়ার পর আমি আমার স্ত্রীর আগ্রহে ছোট্ট পরিসরে ছাদ বাগান করি শুধুই ইস্ট দেবতার পূজার ফুলের জন্যে। তখন থেকেই বাবার চাহিদা ওই ফুল গাছ লাগানোর। আমাকে বলতেন, নিজেও খুঁজতেন। কিন্তু ওই গাছের চারা বা ডাল পাননি।
মারা যাওয়ার মাসখানেক আগে বাবা আমার দাদার বাড়িতে যান এক আত্মীয়ের বিয়ের দাওয়াত খেতে। ফেরার সময় ওখান থেকেই ওই ফুল গাছের চারটি ডাল নিয়ে আসেন। পরদিন আমি ও আমার স্ত্রী ডালগুলো মাটির ব্যাগে রোপণ করি। এর জন্যে গরুর গোবর পর্যন্ত বাবা একজনের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলেন। এর পর থেকে প্রতিদিন ফুল তুলতে গিয়ে ওই গাছের প্রতি বাবার বিশেষ যত্ন ছিল। নিজ হাতে ওই গাছে জল দিতেন। ধীরে ধীরে ডালগুলোতে নতুন কুশি বের হয়। ছাদ বাগানে তার প্রিয় ফুল গাছে নতুন প্রাণের সঞ্চার দেখে বাবা খুবই খুশি হন। অসুস্থ্য মার কাছে গল্প করেন। মাকে ধরে নিয়ে সেই ফুল গাছের লাগানো ডালের নতুন কুশি দেখান। মাকে বলতেন, এবার দুর্গাপূজায় ওই গাছের ফুল দুর্গা মায়ের চরণে অর্পণ করতে পারবেন।
বাবা মারা গেছেন আজ তিন মাস এক সপ্তাহ। কিছুদিন আগে দেখি ওই নতুন কুশিতে ফুলের কলি এসেছে। করোনার কারণে সারাদিন বাড়িতে থাকার কারণে ওই কলিগুলো এতদিন ধীরে ধীরে আমার চোখের সামনে বড় হলো। কাল সকালে আমার স্ত্রী বললো, তোমার জন্যে সারপ্রাইজ আছে ? আমি বুঝলাম না তার কথা। হঠাৎ আমাকে ওই ফুল গাছের কলি দেখিয়ে বললো, ওই দ্যাখো পদ্মফুল গাছের কলি অর্ধেক ফুটে গেছে, কাল পুরোটা ফুটবে। হ্যাঁ, বাবার নিজ হাতে লাগানো তার পছন্দের সেই পদ্মফুল আজ সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে গোলাপী আভার পাপড়ি মেলেছে।
ছাদ বাগানে প্রথম ফোটা পদ্মফুল দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে উঠলাম। হঠাৎই বাবার কথা মনে পরে গেলো। চোখের কোণে জমাট বাঁধলো আনন্দাশ্রু। ফুল দেখে অসুস্থ্য মাও হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। আজকের সকালটা আমার জীবনে সত্যিই অন্য রকম হয়ে ধরা দিল। ফুলের দিকে বার বার তাকালাম। বাবার মুখটা চোখের সামনেই ভাসছিল। গাছে তার জল দেওয়ার মুহূর্তগুলো স্মৃতির ঘরে হামাগুড়ি দিয়ে উঠলো। পরক্ষণেই ভাবলাম – বাবা হয়তো আজ অনেকদিন পর ফুল, তার প্রিয় পদ্মফুল হয়ে আমাদের দেখা দিলো। স্বর্গের অনন্তলোকে তোমার প্রিয় পদ্মফুলের মতো অপার সৌন্দর্য নিয়ে অসীম আনন্দ আর অশেষ শান্তিতে থেকো বাবা – সন্তান হিসেবে এইটুকুই চাওয়া।
তুষার আদিত্য