আপনাকে এখনও আমাদের লালন করার অনেক বাকি!

ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের এয়ারবাসে চেপে যখন যাচ্ছি তখন পাশের সিটে একজন মধ্যবয়সী যুবক আমার পরিচয় জানতেই বললেন, ‘ভাই আপনি যেহেতু ইত্তেফাকে আছেন। নিশ্চয়ই এন্ড্রো কিশোরকে দেখতে যাবেন। তাকে আমার কথা বইলেন। তার গান শুনি নাই, এমন কোনোদিন এই জীবনে যায়নি। আমার কথাটা একটু বইলেন।’
একজন এন্ড্রো কিশোর ও তার গানের প্রতি এমন অদম্য মোহ অগণিত শ্রোতার। সেই বার্তা মাথায় নিয়েই ঠিক করলাম যে করেই হোক এন্ড্রু দার সঙ্গে দেখা করবো। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের ব্লক ৭। শিল্পী এন্ড্রো কিশোর চিকিতৎসাধীন রয়েছেন এখানে। ২৭ অক্টোবর সকালে ফোন করি দেশবরেণ্য গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেতকে। বলি, এন্ড্রো দার সঙ্গে দেখা করবো। ব্যবস্থা করে দেন। সংকেত দা বললেন, ‘আমি কথা বলে তোকে জানাচ্ছি।’
সিঙ্গাপুর ওয়েন রোডের শাহেদ অ্যাপার্টমেন্টের একটি রুমে উঠেছি। এখানে ড্রিমস অ্যারাইভড নামের একটি ব্যান্ডদলের লঞ্চিং অনুষ্ঠানে গাইবো পরদিন। খানিক পরে সংকেত দা বললেন, ‘আমার সঙ্গে কথা হয়েছে তুই যা।’ আমি লিপিকা ভাবীর নম্বর নিয়ে ফোন দেওয়ার কথা ভেবেও ফোন দিইনি। কারণ তখন সন্ধ্যা। তিনি নিশ্চয়ই হাসপাতালে। ভিজিটিং আওয়ার শেষ। তাই দেখা করার সম্ভাবনা নেই। ভাবলাম পরদিন সকালেই ফোন করে দেখা করতে যাবো। পরদিন ফোন করতেই ভাবী বললেন, ‘গতকাল ফোন করলে তো বাসাতেই দেখা করতে পারতেন। আজ আমরা হাসপাতালে চলে এসেছি।’
আহা রে! জানলাম সিঙ্গাপুরের ওয়েন রোডের শাহেদ অ্যাপার্টমেন্টের তৃতীয় তলাতেই তিনি ছিলেন, অর্থাতৎ আমি যে রুমে উঠেছি তার পাশের রুমেই ছিলেন। একসঙ্গে পাশাপাশি রুমেই গোটা একটা রাত ছিলাম অথচ দাদার সঙ্গে দেখা হলো না!
চুপচাপ আলাপে…
হাসপাতালের ব্লক সেভেনে গিয়ে যখন রিসেপশনে জানালাম, এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে দেখা করতে চাই। তখন হেল্প ডেস্কের ওরা পাসপোর্টসহ সব নথি জমা নিয়ে বললেন, ‘আপনার কী হন উনি?’ আমার সঙ্গে থাকা সিঙ্গাপুর প্রবাসী কণ্ঠশিল্পী রুবেল বললেন, ‘উনি বাংলাদেশের বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী। আমরা তার সঙ্গে দেখা করতে বাংলাদেশ থেকে এসেছি।’
ফরমে হেল্প ডেস্কের মেয়েটি সম্পর্কের জায়গায় ‘বন্ধু’ লিখলেন। জানতে চাইলো, এন্ড্রো কিশোরের গান তারা কোথায় পাবে। আমরা তাকে এন্ড্রো কিশোরের গানের কিছু ইউটিউব লিঙ্ক দিয়েদিলাম। বারবার ‘ওয়াও’ উচ্চারণ করে বললেন, তাহলে তো তার অটোগ্রাফ নিতে যেতে হবে তার কাছে।
যাই হোক, অফিসিয়ালি বন্ধু হিসেবেই হাসপাতালে দেশসেরা শিল্পীর সঙ্গে যখন দেখা করতে যাবো তখন দেখলাম বেডে শুয়ে আছেন। তার শিওরে দাঁড়াতেই আমার উপস্থিতি টের পেয়ে বললেন, ‘কে?’ পরে চোখ মেলে আমাকে দেখলেই বললেন, ‘ও তানভীর, তুমি এসেছো, বসো। আমি আর রুবেল দাঁড়িয়ে শুধু দেখলাম অনেকক্ষণ।’ কী কথা বলে শুরু করবো? কেমন আছেন? কেমন কাটছে আপনার? এসব কিছুই জানতে চাইলাম না। তবু এন্ড্রু দা নিজ থেকেই বললেন, ‘এখন অনেকটা ভালো। আমি তো খুব শক্ত স্বভাবের জানোই তো।’
প্রশ্নের আগেই উত্তর
এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে ঢাকায় বেশ ক’বার দেখা হয়েছে। পেশাগত কারণেই ফোনে কখনো ইন্টারভিউ নিয়েছি। দু-বার দেখা করে কথা বলেছি। ইন্টারভিউ ছেপেছি। বরাবরই খুব মাপা উত্তর। বাড়তি কোনো কথা নেই। ইন্ডাস্ট্রিতে যে দু-চারজন শিল্পী গণমাধ্যমে নিজের প্রচারের ব্যাপারে সবচেয়ে উদাসীন তাদের ভেতরে অন্যতম হলেন এন্ড্রু কিশোর। জানতে চাইলাম, আপনি তো মিডিয়া থেকে একেবারেই দূরে থাকলেন।—একথা বলতেই বললেন, ‘শোনো, আমি বিটিভিতে অভিমান করে কেন প্রায় ১ যুগ যাইনি জানো তোমরা?’
আমরা মাথা নাড়াতেই বললেন, ‘শিল্পীর প্রতি অবজ্ঞা, অশ্রদ্ধা আমি কখনোই মেনে নিতে পারিনি। ওই প্রডিউসারের সামনে গিয়ে খোশগল্প মেরে প্রোগ্রাম নিতে হবে এসব আমার মধ্যে ছিল না। একবার বিটিভিতে গান গাইতে গিয়েছি। বিটিভির দোতলার সিঁড়ি ঘরে এক লোক আমাকে বলে বসলো, কী হে বেড়াতে এসেছেন নাকি?
আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলাম। কাছে গিয়ে আমাকে দেখে কী মনে হয় যে বেড়াতে এসেছি। খুব গায়ে লাগলো। আমি তখন জুনিয়র আর্টিস্ট। কিন্তু আর্টিস্ট তো! আমি নাম বলবো না। আমার সঙ্গে অনেকের কাছেই এসব কথা ডাল-ভাত মনে হতো। পরে দেখি ভয়ানক কাণ্ড! আমার প্রোগ্রামের প্রডিউসারই সে! আমি বেরিয়ে এলাম সঙ্গে সঙ্গে। কারণ যে তার শিল্পীকে এভাবে অপমান করে কথা বলতে পারে তার প্রোগ্রাম আমি করবো না। এ রকম অনেক ঘটনা আছে এক জীবনে।
গানের সঙ্গেই বেঁচে থাকা
‘সত্য সাহা আমাকে প্রফেশনাল আর্টিস্ট বানালেন। তখন তো একটা গান নিয়ে পড়ে থাকতাম টানা কয়েকদিন। এর ভেতরে কোনো চাকরির চিন্তা মাথায় আসেনি তা না। কিন্তু বারবার সত্য দার কথা মনে পড়তো। কারণ সত্য দা বলতেন, গানটা করলে শুধু এর সঙ্গেই থাকবি।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তো রাজশাহী থেকে এসে গান করতাম। তখন একেকটা গান গাইতে সুরকারের বাড়িতেই কয়েকদিন পড়ে থাকতে হতো। এমনি এমনি গানগুলো আজও একইরকম আবেদন তৈরি করে না।’
এমন আড্ডা-আলাপে আমার সঙ্গে আসা ছোট ভাই রুবেলকে যখন পরিচয় করিয়ে দিই যে সে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এখানে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশের গানের জন্য কাজ করতে চায়। এন্ড্রো দা তখন সমকালীন গান নিয়ে বলা শুরু করলেন। এ সময়ের গানে একটাই সমস্যা ছেলে মেয়েরা নিজেদের আর ভাঙতে চাইছে না। একটা ট্রেন্ড হিট হলে সেই ট্র্যাকেই থাকতে চাইছে। এটা একটা ভয়ঙ্কর প্রবণতা। এ ব্যাপারে আমার একটা কথা বলি। আমার লিপে যখন ফিল্মে খুব চটুল গান হিট হতে শুরু করলো তখন শেখ সাদী খান, সত্য দাসহ সকলে বললেন তোমাকে কিছু সিরিয়াস টাইপের গান করতে হবে। আমিও তখন বুঝলাম যে, শিল্পীদের ব্যক্তি ইমেজ তৈরি হয় কিন্তু তার গানের ধরনে। এই ছোট্ট কিন্তু গভীর বিষয় এখনকার ছেলেমেয়ের বোঝাটা খুব জরুরি।
কীভাবে কাটছে হাসপাতালের দিনগুলো
‘সারাদিন বিভিন্ন কথা ভাবি। তোমার ভাবীর সঙ্গে গল্প করি। এই যে তোমরা আমাকে দেখতে আসো। কিছুদিন আগে খুরশীদ ভাই এলেন। উনিও এখানে গান করতে এসেছেন। তার আগে ওমর সানী-মৌসুমী এসেছিল। ওরা আমার সঙ্গে ছবি তোলার পর বলেছিলাম, পাবলিকলি পোস্ট না দিতে। কারণ হাসপাতালেরও বারণ রয়েছে। কিন্তু সানী ওটা পোস্ট দিয়ে তা খবরে প্রকাশ পেয়ে হুলস্থুল কাণ্ড। এমনিতে সারাদিন বেশ কেটে যায়, তবে খারাপ লাগে। আমি তো অনেক কোলাহলে থাকা মানুষ। এখন মনে হচ্ছে কোনো দ্বীপে বসে আছি। তাই বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে কথা বলি।’
আমার সারা দেহ খেও গো মাটি
আমরা দু’জন কথা বলছি। আর চারপাশ দিয়ে ছায়াশরীরের মতো পায়চারি করছেন এন্ড্রু দার স্ত্রী। বারবার আমাদের সাবধান করে দিচ্ছেন আস্তে কথা বলার জন্য। রুবেল গুনগুনিয়ে এন্ড্রো দাকে শোনাতে চাইলেন, ‘আমার সারা দেহ খেও গো মাটি এই চোখ দুটো।’
এন্ড্রু দা মজা করে বললেন, ‘আরে ক্যানসারে তো আমার শরীরটাই খেয়ে ফেলছে।’ জানতে চাইলাম এত প্রাণশক্তি কীভাবে পান। দাদা বললেন, ‘এই যে একটা জীবনে লাখ লাখ মানুষকে দেখে। এত এত মানুষের ভালোবাসাই আমার প্রাণশক্তি।
প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে অর্থ সাহায্য আমি গ্রহণ করেছি। এ নিয়ে তোমরা লিখেছো। খানিকটা অভিমান-রাগ করেছো। কিন্তু তিনি তো আমাদের মাতৃতুল্য। তিনি সাহায্য দিতে চাইলে নেবো না? আরে আমি তো বিলিয়নার না। এই একটা মানুষ শুধু গান গেয়ে সবকিছু করেছি। এটাও তো বুঝতে হবে।’
দাদাকে কিছুই বলতে হলো না। নিজেই বললেন, ‘আমি যে কোথাও চ্যারিটি করিনি এটা আমি বুঝে-শুনেই করেছি। আচ্ছা, আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও, এই যে চ্যারিটি করে নিজেকে নিজে ঠকিয়ে আমি কী শেষ বয়সে কোনো ফান্ড পেতাম। কোনো পয়েন্ট যোগ হতো। আমি তাই দৃঢ়চিত্তে বলতে চাই, বিনে পয়সায় আমি একটা গানও কোনোদিন করিনি। এটাই আমার পণ। সুবীর দা, বিশ্বজিতসহ অনেকেই আমাকে বলেছে। আমি রাজি হইনি।’
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে ছাড়িয়ে
‘জীবনে কত অর্গানাইজারের সঙ্গে পেমেন্ট নিয়ে ঝগড়া হয়েছে হিসেব নেই। একবার তো কলকাতার এক অর্গানাইজারের সঙ্গে তুমুল তর্ক। কারণ ওরা পেমেন্ট না দিয়েই কেটে পড়ার চিন্তা করছিল। আমি আর সাবিনা ইয়াসমিন ছিলাম পারফর্মার। সাবিনা বলছিলেন, থাক বাদ দাও। কী ভাববে।
আমি পরে সবার সামনে ওকে ধরলাম। শিল্পীর পয়সা মেরে খাবি মানে। পরে ঠিকই আমি আমার পেমেন্ট নিয়ে দেশে এসেছি। সাবিনা কিন্তু পেমেন্ট পাননি!’
আমি এন্ড্রো দার কথার সঙ্গে আরো খানিকটা যোগ করে বললাম, দাদা আপনি দেখি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো। হেমন্ত দার এমন খবর পড়লাম আনন্দবাজারে। তিনিও নাকি পেমেন্ট ছাড়া গান গাইতে উঠতেন না।
‘আরে রাখো হেমন্ত দার কথা। আমার গল্প শুনলে হা হয়ে যাবা। আমি এমনই ভাই। শিল্পী হয়েছি সাধনা করে। কেউ আমাকে ঠকাবে এটা মানতে পারবো না।’
কিন্তু দাদা আপনার গানের রিংটোন ওয়েলকাম টোনে তো হরিলুট হয়েছে। আপনার রয়ালিটি কী পেয়েছেন? দাদা বললেন, ‘সে কথা আর বইলো না। সে আরেক তর্ক।’
আমি আর কথা বাড়ালাম না। দাদাকে দেখতে এসে মাত্র কিছুক্ষণের জন্য আলাপের অনুমতি পেয়েছিলাম। কিন্তু দাদা যেন কথার ডালপালা মেললেন আরো। ভাবী মৃদুস্মরে বললেন, ‘তোমাদের দাদার এত কথা বলার অনুমতি নেই।’
এন্ড্রু দা আধশোয়া থেকে উঠে দাঁড়ালেন। আমাদের এগিয়ে দিতে চাইতেই বাঁধা দিলাম। দাদা বললেন, ‘ভালো থাকো। ভালো ভালো গান করো। যাতে বাংলা গান ভালো থাকে।’
দাদাকে বললাম, আপনি সুস্থ হয়ে দেশে আসবেন খুব জলদি আমরা জানি। কারণ আপনার যে প্রাণশক্তি, এই শক্তিকে ঈশ্বর এত জলদি দুর্বল করবেন না। এই বাংলা গানকে যা দিয়েছেন তাতে আপনি চিরস্মরণে রয়ে আছেন অনেক আগেই। এখনও আপনাকে আমাদের লালন করার বাকি! ভালো থাকবেন দাদা।
তানভির তারেক, সিনিয়র সাংবাদিক