রবীন্দ্রনাথের অপ্রচলিত গানগুলো শোনাতে চাই : বর্ণালী বিশ্বাস

রবীন্দ্রনাথের গান ‘সর্বজনের, সর্বকালের, সর্বযুগের’। এই বিশ্বাস এবং অনুভূতিকে হৃদয়ে ধারণ করে রবীন্দ্র সংগীত করেন এ সময়ের প্রতিশ্রæতিশীল রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী বর্ণালী বিশ্বাস। রবীন্দ্রনাথের শ্বশুর বাড়ী দক্ষিণ ডিহির পাশেই খুলনা জেলার ফুলতলা থানা। রবীন্দ্র সংগীতে নিবেদিতপ্রাণ শিল্পী বর্ণালী বিশ্বাসের বাড়ি সেখানেই। ছোটবেলায় বেড়ে ওঠা কিংবা গান শেখা, বর্ণালীর সবকিছুই হয়েছে সেখানে। গানের হাতেখড়ি নাসির হায়দার নামে একজন স্থানীয় শিক্ষকের কাছে। এরপর ক্লাসিক্যাল ও রবীন্দ্রসংগীত শেখা। মূলত মা’র ইচ্ছেতেই ছোটবেলা থেকে গানের সঙ্গে সখ্য তার।
খুলনা বি এল কলেজ কলেজে অনার্স পড়াকালীন সময় সংগীত সাধনাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে বড় ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন বর্ণালী ও তার পরিবার। আইসিসিআর থেকে স্কলারশিপ পান বর্ণালী। সেই সুবাদে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ‘বেঙ্গল মিউজিক কলেজ’ এ ভর্তি হন রবীন্দ্র সংগীত বিষয়ে পড়াশোনার জন্য। এটা ২০০৭ সালের কথা। এরকম একটি সিদ্ধান্ত থেকে অনায়াসে বোঝা যায়, বর্ণালী কিংবা তার পরিবার রবীন্দ্র সঙ্গীতের বিষয়ে কতটুকু সিরিয়াস। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও তার পরিবার গান নিয়ে পড়াশোনার জন্য তাকে কলকাতায় পাঠানোর বিষয়টি একটু দুঃসাহসিকই বটে! কারণ, বর্তমানে প্রতিটি মা-বাবাই চায় তাদের সন্তান এমন কোন বিষয়ে পড়াশোনা করুক যেটার ক্যারিয়ার খুব ভালো কিংবা এক কথায় বলতে গেলে যে বিষয়ে পাশ করলে আয়-রোজগার ভালো করা যাবে। চাকরির বাজার ভালো এমন সাবজেক্টের প্রতিই সবার দৃষ্টি থাকে। কিন্তু বর্ণালী কিংবা তার পরিবার সে পথে হাঁটেননি। তারা গুরুত্ব দিয়েছেন সৃজনশীলতার প্রতি। সেক্ষেত্রে রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে পড়াশোনা করার বিষয়টি একদিকে যেমন তার পরিবারের রুচিঋদ্ধ প্রেক্ষিতটি বুঝিয়ে দেয়, তেমনি শুদ্ধ সংগীতের প্রতি তাদের আগ্রহেরও পরিচয় দেয়। যাই হোক, অনার্সে প্রথম বিভাগে পাশ করার পর ২০১০ সালে মাস্টার্স করার জন্য রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন বর্ণালী। ২০১২ সালে প্রথম বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
এদিকে, কলকাতায় রবীন্দ্র সংগীতের নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবেও রবীন্দ্র সংগীতের উপর তালিম নেন সেখানকার সুখ্যাত রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী শ্রমনা চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। আবার সঞ্চালিকা ভট্টাচার্য’র কাছে শিখেছেন ক্লাসিক্যাল। পাশাপাশি অংশ নিয়েছেন স্থানীয় অনেক অনুষ্ঠানে। পশ্চিমবঙ্গের ‘বাংলা সংগীত মেলা’ তে গান করারও সুযোগ পেয়েছেন তিনি। সেখানে তিনি ‘এ’ গ্রেডের তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। এছাড়া ২০০৮ সালের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে ‘বিধান নগর সাংস্কৃতিক অঙ্গন’ আয়োজিত পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্র সংগীতের উপর একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সেখানে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন বর্ণালী। প্রথম তিনজনকে নিয়ে গানের একটি সিডিও প্রকাশ করা হয় তখন। এরপর বসন্তের ১০ টি রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে কলকাতার শ্রীনিবাস মিউজিকের ব্যানারে বাজারে আসে বর্ণালীর প্রথম সলো অ্যালবাম ‘রবির রঙে’ শিরোনামে। প্রথম অ্যালবামেই রবীন্দ্র সংগীত বোদ্ধাদের ভূয়সী প্রশংসা লাভ করেন বর্ণালী।
রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্র সংগীতের উপর মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর ২০১২ সালে দেশে ফিরে আসেন বর্ণালী বিশ্বাস। দেশে ফিরে নিয়মিত গান চর্চার পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পারফর্ম করেন। রবীন্দ্র সংগীতের অনেকগুলো মিক্সড অ্যালবামে গান করেন তিনি। বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত কন্ঠশিল্পী বর্ণালী বিশ্বাস রবীন্দ্র সংগীতের পাশাপাশি আধুনিক গানও করেন। ২০১৮ সালে সঙ্গীতার ব্যানারে তার একটি আধুনিক গান রিলিজ হয় ইউটিউব চ্যানেলে। এছাড়া বহুল প্রচলিত গান ‘ছেড়ে দিলে সোনার গৌর’ এর কাভার সঙ গেয়েছেন। যার মিউজিক ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। আবার তিনি যখন ক্লোজ আপ ওয়ানের কনটেস্টেন্ট ছিলেন তখন একটি মৌলিক গানও গেয়েছিলেন। জাহাঙ্গীর আলমের কথা ও মকসুদ জামিল মিন্টুর সুরে গানটির শিরোনাম ‘রং কিনেছি রং লাগাবো’।
বর্ণালী বিশ্বাসগান গাওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত উপস্থাপনাও করেন বর্ণালী বিশ্বাস। শুরুটা হয়েছিলো এসএ টিভির মাধ্যমে। সেখানকার নিয়মিত অনুষ্ঠান ‘রবির আবির’ এ ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত এক বছর নিয়মিত উপস্থাপনা করেছেন। আর এখন সঞ্চালনা করছেন এনটিভির সকাল ৮.১০ এর লাইভ অনুষ্ঠান ‘আজ সকালের গানে’ তে। সংগীত শিল্পীদের অংশগ্রহণে এ অনুষ্ঠানটি হয়ে থাকে। নিজেও একজন সংগীত শিল্পী বিধায় এ ধরনের অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন বর্ণালী।
‘চর্চার মধ্য দিয়েই যে কোন অর্জনকে ধরে রাখতে হয়’ এই বিষয়টি মাথায় রেখেই এখনও নিয়ম করে সংগীত চর্চা করেন বর্ণালী। মঞ্চ ও টেলিভিশনে নিয়মিত অনুষ্ঠান করার পাশাপাশি রবীন্দ্র সংগীত শিখছেন দেশের অন্যতম জনপ্রিয় রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার কাছে। পাদপ্রদীপের আলোয় আলোকিত হবার আশায় অনেক শিল্পী অর্থ বিনিয়োগ করে নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টা করে থাকে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এখন এই নীতিতে চলছে সবাই। কিন্তু বর্ণালী সেরকম না। বানের জলে ভেসে এসে আবার বানের জলে হারিয়ে যাবার মতো মানসিকতা তার নেই। রবীন্দ্র সংগীতকে ভালোবেসে নিজের জীবনের আলাদা কোন ক্যারিয়ার তৈরি করেননি তিনি। পড়াশোনা, শখ, স্বপ্ন কিংবা ক্যারিয়ার সব কিছুই একই সুতোয় গাঁথা। সুতরাং তাড়াহুড়ো করতে চান না তিনি।
অঞ্জন দাস