যার কণ্ঠে সিনেমার ১০ হাজারেরও বেশি গান

ঢাকাই সিনেমার ইন্ডাস্ট্রিতে অনন্য এক সংযোজন ‘নতুন সুর’। এহতেশাম পরিচালিত সিনেমাটি ১৬ নভেম্বর, ১৯৬২ সালে মুক্তি পায়। সেখানে গান শিশু শিল্পী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন আজকের কিংবদন্তি সাবিনা ইয়াসমিন।
সেই শুরু। দিনে দিনে নিজেকে তিনি বাংলা গানের পাখি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। হয়ে উঠেছেন কালজয়ী এক নাম। জয় করেছেন এ দেশের পাঁচটি দশকের দর্শক।
সামগ্রিক ক্যারিয়ারে সর্বমোট কত হাজার গান গেয়েছেন তার সঠিক হিসেব হয়তো সাবিনা নিজেও দিতে পারবেন না। তবে শিল্পীর ধারণা চলচ্চিত্রেই তিনি প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। সবমিলিয়ে ১৫-১৬ হাজার গান তিনি গেয়েছেন। এ এক অনন্য রেকর্ড, অসাধারণ এক অর্জন একজন কণ্ঠশিল্পী হিসেবে।
পৈত্রিক বাড়ি সাতক্ষীরায় হলেও সাবিনা ইয়াসমিনের জন্ম হয় ঢাকায়। ৫ বোনের মাঝে ৪ বোনই গান করেছেন। তারা হলেন ফরিদা ইয়াসমিন, ফওজিয়া খান, নীলুফার ইয়াসমিন এবং সাবিনা ইয়াসমিন।
তার বড় বোন ফরিদা ইয়াসমিন যখন গান শিখেন দুর্গাপ্রসাদ রায়ের কাছে তখন ছোট্ট সাবিনাও উপস্থিত থাকতেন। পরবর্তীতে ওস্তাদ পি সি গোমেজের কাছে একটানা ১৩ বছর তালিম নিয়েছেন তিনি। মাত্র ৭ বছর বয়সে স্টেজ প্রোগ্রামে অংশ নেন। ছোটদের সংগঠন খেলাঘরের সদস্য হিসেবে রেডিও ও টেলিভিশনে গান গান নিয়মিত। ‘নতুন সুর’ সিনেমাতে প্রথম গান করলেও নায়িকাদের জন্য তিনি প্রথম প্লেব্যাক করেন ১৯৬৭ সালে ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছবিতে ‘মধুর জোছনা দীপালি’ গানটির মাধ্যমে।
এরপর বহু বহু জনপ্রিয়, কালজয়ী গান তিনি গেয়েছেন। ষাট দশকের নায়িকা সুমিতা-সুচন্দা থেকে শুরু করে আজকের মাহিয়া মাহিদের জন্যও তিনি গান করেছেন। মরমী শিল্পী সেই আব্দুল আলীম থেকে শুরু করে একালের উঠতি গায়কের সাথেও অবিরাম গেয়ে চলেছেন একের পর এক গান।
এত লম্বা ক্যারিয়ার ও গানের পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের ইতিহাসে একমাত্র রুনা লায়লাকেই তার সমকক্ষ হিসেবে ধরা যায়। বাকীদের কাছে সাবিনা গানের সমুদ্রের মতো।
সাবিনা ইয়াসমিন সুযোগ পেয়েছেন উপমহাদেশের বরেণ্য সুরকার আর. ডি. বর্মণের সুরে গান গাওয়ার। তিনি দ্বৈত কণ্ঠে গেয়েছেন বিখ্যাত কিশোর কুমার, মান্না দের মতো উপমহাদেশের সুপারস্টার গায়কদের সঙ্গে।
এক সাক্ষাতকারে জানিয়েছিলেন ছোটবেলায় প্রতিমা ব্যানার্জির মতো গান গাইতে চেষ্টা করতেন। লতা, আশা, নির্মলা মিশ্র, গীতা দত্ত এদের গানও ভালো লাগতো। ৭২ সালের কথা। বোম্বেতে গানের একটি অনুষ্ঠানে গান গাইছেন। শ্রোতা হিসেবে আছেন এসডি বর্মন, অমিতাভ বচ্চন, জয়া ভাদুড়ী, রাজকুমারসহ আরো অনেকে। হঠাৎ দেখেন লতা মঙ্গেশকর ঢুকছেন। তাকে দেখে ভয় পেয়ে সাবিনা হারমোনিয়াম বন্ধ করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন। তারপর সবাই আবার জোর করে ধরে বসিয়ে দিলো। শচীন দেবের অনুরোধে গাইলেন ‘নাইয়ারে নাওয়ের বাদাম তুইলা’। তখন লতা মঙ্গেশকর উঠে এসে সাবিনা ইয়াসমিনকে আশীর্বাদ করলেন।
সিনেমা ছাড়াও ক্যারিয়ারজুড়ে নানা রকম গানে সফল হয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন। নজরুল সংগীতের পাশাপাশি রবীন্দ্র সংগীতও রেকর্ড করেছেন। যেমন ‘বধু বিদায়’ ছবিতে ‘আমার যাবার সময় হলো দাও বিদায়’, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ ছবিটির রিমেক ভার্শনে ‘পথহারা পাখি কেঁদে ফিরে একা’, ‘লাইলী-মজনু’ ছবিতে ‘লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া’ গানটি করেছেন। তপন মাহমুদের সাথে রবীন্দ্র সঙ্গীতের ডুয়েট অ্যালবামও বের করেছেন।
দেশের গানেও কিংবদন্তি তিনি। বলা চলে অপ্রতিদ্বন্দ্বীও। এ পর্যন্ত প্রায় ৫০টি দেশের গান গেয়েছেন তিনি। জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো, সব ক’টা জানালা খুলে দাও না, সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবন্য, সেই রেল লাইনের ধারে, মাগো আর তোমাকে, একতারা লাগে না আমার, একটি বাংলাদেশ তুমি, ও আমার বাংলা মা তোর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন সাবিনা ইয়াসমিন। নায়িকার হাতের প্রক্সি হিসেবে ‘মনের মতো বউ’ ছবিতে ‘এ কি সোনার আলোয়’ গানে পিয়ানো বাজানোর দৃশ্য খান আতা শুট করেছিলেন সাবিনা ইয়াসমিনকে দিয়ে। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘উল্কা’ চলচ্চিত্রে অবশ্য স্বনামেই একটি গানের দৃশ্যে অভিনয় করেছেন সাবিনা ইয়াসমিন।
ব্যক্তিজীবনে একজন ব্যাংকারের সঙ্গে প্রথম বিয়ে ভেঙে যাবার পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন নৃত্য পরিচালক আমির হোসেন বাবুকে। ২০০০ সালে বিয়ে করেন নন্দিত গায়ক কবীর সুমনকে। সে সংসারও টিকেনি তার। খাম খেয়ালিতে আসক্ত কবীর সুমনকে ছেড়ে একাই বাস করছেন তিনি এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে।
দেড় হাজারেরও বেশি ছায়াছবিতে কণ্ঠ দিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন। সেরা কণ্ঠের গায়িকা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পেয়েছেন ১৩বার। ছবিগুলো হলো- সাধারণ মেয়ে (১৯৭৫), গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮), সুন্দরী (১৯৭৯), কসাই (১৯৮০), চন্দ্রনাথ (১৯৮৪), প্রেমিক (১৯৮৫), রাজলক্ষী শ্রীকান্ত (১৯৮৭), দুই জীবন (১৯৮৮), দাঙ্গা (১৯৯১), রাধাকৃষ্ণ (১৯৯২), দুই দুয়ারী (২০০০), দুই নয়নের আলো (২০০৬), দেবদাস ২০১৩ ।
সঙ্গীতে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতা পদক এবং ১৯৮৪ সালে একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। ৫বার পেয়েছেন বাচসাস পুরস্কার। আর ১৯৮৫ সালে গানের জন্য ভারত থেকে ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রিও লাভ করেছেন সাবিনা ইয়াসমিন। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসাকেই নিজের জীবনের সের অর্জন বলে মনে করেন সাবিনা ইয়াসমিন।
সেই ভালোবাসা আর প্রার্থনাতে তিনি জয় করতে পেরেছেন মরনব্যাধি ক্যান্সারকেও। ২০০৭ সালে এই গানের পাখি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। সবার দোয়ায় তিনি ক্যান্সার জয় করে আবারও সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন ফিরে পান। এখনো তিনি গান করে চলেছেন। এই গান গাওয়া চলুক অবিরাম।
রোমান রায়