২০১৪ সালের ১৯শে এপ্রিল শনিবার রাত ১০.৩০ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। উল্লেখ্য দিল্লির সওদাগর পরিবারের সন্তান বশির আহমেদ ১৯৩৯ সালের ১৯ নভেম্বর কলকাতার খিদিরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম নাসির আহমেদ। খুব ছোট বেলা থেকেই তিনি সঙ্গীতপাগল ছিলেন। মা’র কাছে ঘুম পাড়ানি গান শুনে শুনেই প্রথম গানে আগ্রহ তৈরি হয় তার। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি ওস্তাদ বেলায়েত হোসেন এর কাছে গান শিখতে শুরু করেন। তারপর তিনি বম্বেতে চলে যান। সেখানে উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ’র কাছে তালিম নেন এবং তার কাছ থেকে বশির আহমেদ প্রচুর অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। বশির আহমেদ ছিলেন একাধারে কন্ঠশিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক। একুশে পদক,জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার সহ অসংখ্য পুরস্কারে ভুষিত হয়েছেন তিনি। ষাটের দশকের শুরুতে তিনি সপরিবারে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় আসার আগেই উর্দু চলচ্চিত্রে গান গাওয়া শুরু করেন তিনি। ওই সময়ই শিল্পী হিসেবে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর কণ্ঠ ছিল মাধুর্যে ভরা। রাগসংগীতেও দখল ছিল তাঁর। তালাশ’ চলচ্চিত্রে বিখ্যাত শিল্পী তালাত মাহমুদের সঙ্গে কাজ করেন। রেডিও পাকিস্তানেও গান গেয়েছেন তিনি। চিত্রনির্মাতা মোস্তাফিজ তার ‘সাগর’ ছবির গান লেখার জন্য বশির আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং জানতে চান তিনি গান লিখতে পারবেন কি না। বশির আহমেদ সেই ছবির গানটি লিখেছিলেন এবং চমৎকারভাবে গেয়েছিলেন ‘জো দেখা প্যায়ার তেরা’। একইভাবে রবিন ঘোষও তার ছবির গান লেখার জন্য বশির আহমেদকে অনুরোধ করেন। ১৯৬৪ সালে ‘কারোয়ান’ ছবির জন্য বশির আহমেদ লিখেছিলেন এবং অসাধারণ গেয়েছিলেন ‘যব তোম একেলে হোগে হাম ইয়াদ আয়েঙ্গে’ গানটি। রেডিও পাকিস্তানে ষাটের দশকে সবচেয়ে বেশি বাজতো এই গানটি। সেই থেকেই ছায়াছবিতে তার গান লেখা শুরু হয়েছিল এবং নিয়মিত গাওয়া। তার গাওয়া ছবিগুলো- সাগর, কারোয়ান, ইন্ধন, কঙ্গন, দর্শন এবং মিলন। শবনম ও রহমান অভিনীত দর্শন ছবিতে বশির আহমেদ গেয়েছেন-চমৎকার একটি গান ‘তুমহারে লিয়ে ইস দিলমে যিতনি মোহাব্বত হ্যায়…’সুরকার ও গীতিকার বশির আহমেদ। দর্শন ছবিটি মুক্তি পেয়েছে ১৯৬৭ সালে। অনেকেই জানেন না যে বাংলাদেশের এই বিখ্যাত গায়ক বাঙালি ছিলেন না, এমন কি তিনি বাংলা ভাষাও জানতেন না । তিনি ছিলেন কলকাতার সওদাগর পরিবারের সন্তান। তার পরিবার ছিল উর্দুভাষী। তিনি আহমেদ রুশদী বলে পরিচিত ছিলেন। আহমেদ রুশদী পাকিস্তানি চলচ্চিত্র জগতের বিখ্যাত গায়ক ছিলেন। ষাটের দশকে ঢাকায় আসার পর বশির আহমেদের ভগ্নিপতি ইসরাত কালভি তাকে সুরকার রবিন ঘোষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ইশরাত সাহেব তখন তালাশ ছবির জন্য গান লিখছিলেন। ওই ছবির আরও কিছু গান লিখেছিলেন সুরুর বারাবাঙ্কভি। গানগুলোর সুর দিয়েছিলেন রবিন ঘোষ। তিনি বশির আহমেদকে একটি সুযোগ দিয়েছিলেন নিজেকে প্রমাণ করার জন্য। বশির আহমেদ তালাশ এর জন্য গান গেয়েছিলেন। তার মধ্যে খুব রোমান্টিক একটি গান- ‘কুছ আপনি ক্যাহিয়ে, কুছ মেরি সুনিয়ে…’ চমৎকার গেয়েছেন। তালাশ ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৩ সালে। ১৯৬০ সালে সংগীত-সত্য সাহা ও সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ ছবিতে গেয়েছেন তার হিট করা গান-অথৈ জলে ডুবে যদি মানিক পাওয়া যায়। ১৯৬৯ সালে ময়নামতি ছবিতে ‘অনেক সাধের ময়না আমার’ এই আবেগী আর বিরহী গান দিয়ে মাত করেন বশির আহমেদ। ষাট ও সত্তর দশকের জনপ্রিয় শিল্পী ও সুরকার বশির আহমেদ। ঢাকা আর লাহোরের ছবিতে প্রচুর প্লে ব্যাক করেছেন তিনি। তার স্ত্রী নেপালী কন্যা মীনা বশিরও একজন গুনী কণ্ঠশিল্পী। ‘ও গো প্রিয়তমা’ আর ‘তোমাকে তো না করেছি ফুলের তোড়া দিও না গো’ এই দুটি ডুয়েট গেয়েছেন বশির আহমেদ ও মীনা বশির। মীনার বোন মালা সিনহা ভারতীয় চলচ্চিত্রের বিখ্যাত অভিনেত্রী ছিলেন। বশির আহমেদ এবং মীনা বশির বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাদেরই সুযোগ্য সন্তান হিসেবে শুদ্ধ সঙ্গীত চর্চা করছেন মেয়ে হুমায়রা বশির এবং ছেলে রাজা বশির। ইতিমধ্যেই দুই ভাই-বোন মিলে শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন বেশ কিছু জনপ্রিয় অ্যালবাম। বশির আহমেদ এর গাওয়া জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে: ‘অনেক সাধের ময়না আমার’, ‘আমাকে পোড়াতে যদি এত লাগে ভালো’, ‘যারে যাবি যদি যা/পিঞ্জর খুলে দিয়েছি’, ‘ডেকো না আমারে তুমি/কাছে ডেকো না’,কত আশা ছিল মনে, সজনি গো ভালোবেসে এতো জ্বালা, প্রেমের এক নাম জীবন, তোমার কাজল কেশ ছড়ালে যখন, অথৈই জ্বলে ডুবে যদি মানিক পাওয়া যায়,আমার এই মন আমি যারে দিতে চাই, আমি রিকশাওয়ালা, আমার খাতায় প্রতি পাতায়, মানুষের গান আমি শুনিয়ে যাবো প্রভৃতি। ১৯৬২ সাল থেকে বশির আহমেদ ঢাকার সংগীত ভুবনে জড়িয়ে পড়েন। এর আগে তিনি কলকাতা ও বোম্বেতে গান করতেন। আধুনিক বাংলা গান, ছায়াছবির গান এবং গজল গেয়েই তিনি খ্যাত। ঢাকায় নির্মিত (১৯৬২ থেকে ১৯৭০) উর্দু ছবি – তালাশ, সাগর, কারওয়া, মিলন, মালা, দরশন প্রভৃতিতে তাঁরগানগুলো একসময় অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। বশির আহমেদ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলে নূরজাহানের সাথে অনেক উর্দু গানও গেয়েছিলেন। এছাড়াও ১৯৫৪ – ৫৫ সালে বশির আহমেদ বোম্বেতে থাকাকালীন সময় তিনি গীতা দত্ত, আশা ভোঁসলের সঙ্গে ও ডুয়েট গান করেছেন। বশির আহমেদ ২০১৪ সালের ১৯ এপ্রিল রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরে নিজ বাসায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বশির আহমেদের মৃত্যুর পর একই বছর (৭ আগস্ট) স্ত্রী মীনা বশির মারা যান। মোহাম্মদপুরে সলিমউল্লাহ সড়কের কবরস্থানে বশির আহমেদের সমাধির পাশে মীনা বশিরকে দাফন করা হয়।
রেজা মতিন